টুনটুনির বই/টুনটুনি আর নাপিতের কথা

উইকিসংকলন থেকে

টুনটুনি আর নাপিতের কথা

টুনটুনি গিয়েছিল বেগুন পাতায় বসে নাচতে। নাচতে-নাচতে খেল বেগুন কাঁটার খোঁচা। তাই থেকে তার হল মস্ত বড় ফোড়া।

 ও মা, কি হবে? এত বড় ফোড়া কি করে সারবে?

 টুনটুনি একে জিগগেস করে, তাকে জিগগেস করে। সবাই বললে, ‘ওটা নাপিত দিয়ে কাটিয়ে ফেল।’

 তাই টুনটুনি নাপিতের কাছে গিয়ে বললে, ‘নাপিতদাদা, নাপিতদাদা, আমার ফোড়াটা কেটে দাও না!’

 নাপিত তার কথা শুনে ঘাড় বেঁকিয়ে নাক সিঁটিকিয়ে বললে, ‘ঈস্! আমি রাজাকে কামাই, আমি তোর ফোড়া কাটতে গেলুম আর কি!’

‘ঈস্! আমি রাজাকে কামাই, আমি তোর ফোড় কাটতে গেলুম আর কি?’

 টুনটুনি বললে, ‘আচ্ছা, দেখতে পাবে এখন, ফোড়া কাটতে যাও কিনা।’

 বলে সে রাজার কাছে গিয়ে নালিশ করলে. ‘রাজামশাই, আপনার নাপিত কেন আমার ফোড়া কেটে দিচ্ছে না? ওকে সাজা দিতে হবে।’

 শুনে রাজামশাই হো-হো করে হাসলেন, বিছানায় গড়াগড়ি দিলেন, নাপিতকে কিছু বললেন না। তাতে, টুনটুনির ভারী রাগ হল। সে ইঁদুরের কাছে গিয়ে বললে, ‘ইঁদুরভাই, ইদুরভাই, বাড়ি আছ?’

 ইঁদুর বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই! এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’

রাজ হো-হো করে হাসলেন। [ পৃষ্ঠা ৬

 টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি এক কাজ কর।’

 ইঁদুর বললে, ‘কি কাজ?’

 টুনটুনি বললে, ‘রাজামশাই যখন ঘুমিয়ে থাকবেন, তখন গিয়ে তাঁর ভুঁড়িটা কেটে ফুটো করে দিতে হবে।’

 তা শুনে ইঁদুর জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে বললে, ‘ওরে বাপরে! আমি তা পারব না।’ তাতে টুনটুনি রাগ করে বিড়ালের কাছে গিয়ে বললে, ‘বিড়াল ভাই, বিড়ালভাই, বাড়ি আছ?’

 বিড়াল বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’

‘ওরে বাপরে! আমি তা পারব না।’

 টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি ইঁদুর মার।’

 বিড়াল বললে, ‘এখন আমি ইঁদুর-টিদুর মারতে যেতে পারব না, আমার বড্ড ঘুম পেয়েছে।’ শুনে টুনটুনি রাগের ভরে লাঠির কাছে গিয়ে বললে, ‘লাঠিভাই, লাঠিভাই, বাড়ি আছ?’

 লাঠি বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’

 টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি বিড়ালকে ঠেঙাও।’

 লাঠি বললে, ‘বিড়াল আমার কি করেছে যে আমি তাকে ঠেঙাতে যাব? আমি তা পারব না।’ তখন টুনটুনি আগুনের আছে গিয়ে বললে, ‘আগুনভাই, আগুনভাই, বাড়ি আছ?’

‘অত জল খেতে পারব-না, আমার পেট ফেটে যাবে।’ [পৃষ্ঠা ১০

 আগুন বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’

 টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি তুমি লাঠি পোড়াও।’

 আগুন বললে, ‘আজ ঢের জিনিস পুড়িয়েছি, আজ আর কিছু পোড়াতে পারব না।’ তাতে টুনটুনি তাকে খুব করে বকে, সাগরের কাছে গিয়ে বললে, ‘সাগরভাই, সাগরভাই, বাড়ি আছ?’

 সাগর বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’

 টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি তুমি আগুন নিবাও।’

 সাগর বললে, ‘আমি তা পারব না।’ তখন টুনটুনি হাতির কাছে গিয়ে বললে, ‘হাতিভাই, হাতিভাই, বাড়ি আছ?’

মশায় আকাশ ছেয়ে গেল। [ পৃষ্ঠা ১১

 হাতি বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’

 টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি সাগরের জল সব খেয়ে ফেল।’

 হাতি বললে, ‘অত জল খেতে পারব না, আমার পেট ফেটে যাবে।’

 কেউ তার কথা শুনল না দেখে টুনটুনি শেষে মশার কাছে গেল। মশা দূর থেকে তাকে দেখেই বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’

 টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি হাতিকে কামড়াও!’

 মশা বললে, ‘সে আবার একটা কথা! এখুনি যাচ্ছি! দেখব হাতি বেটার কত শক্ত চামড়া!’ বলে, সে সকল দেশের সকল মশাকে ডেকে বলল, ‘তোরা আয় তো রে ভাই, দেখি হাতি বেটার কত শক্ত চামড়া।’ অমনি পীন্‌-পীন্‌-পীন্‌-পীন্‌ করে যত রাজ্যের মশা, বাপ বেটা ভাই বন্ধু মিলে হাতিকে কামড়াতে চলল। মশায় আকাশ ছেয়ে গেল, সূর্য ঢেকে গেল। তাদের পাখার হাওয়ায় ঝড় বইতে লাগল। পীন্‌-পীন্‌-পীন্‌-পীন্‌ ভয়ানক শব্দ শুনে সকলের প্রাণ কেঁপে উঠল। তখন—

হাতি বলে, সাগর শুষি!
সাগর বলে, আগুন নেবাই!
আগুন বলে, লাঠি পোড়াই!
লাঠি বলে, বিড়াল ঠেঙাই!
বিড়াল বলে, ইঁদুর মারি!
ইঁদুর বলে, রাজার ভুঁড়ি কাটি!
রাজা বলে, নাপতে বেটার মাথা কাটি!

 নাপিত হাত জোড় করে কাঁপতে-কাঁপতে বললে, ‘রক্ষে কর, টুনিদাদা! এস তোমার ফোড় কাটি।’

 তারপর টুনটুনির ফোড়া সেরে গেল, আর সে ভারী খুশী হয়ে আবার গিয়ে নাচতে আর গাইতে লাগল—টুনটুনা টুন্‌ টুন্‌ টুন্‌! ধেই ধেই!