বেতালপঞ্চবিংশতি/উপক্রমণিকা

উইকিসংকলন থেকে

বেতালপঞ্চবিংশতি

উপক্রমণিকা

উজ্জয়িনী নগরে গন্ধর্ব্বসেন নামে রাজা ছিলেন। তাঁহার চারি মহিষী ছিল। তাহাদের গর্ভে রাজার ছয় পুত্র জন্মে। রাজকুমারেরা সকলেই সুপণ্ডিত ও অতিশয় বলবান্‌ ছিলেন। কালক্রমে নৃপতির লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে সর্ব্বজ্যেষ্ঠ শঙ্কু সিংহাসনে অধিরোহণ করিলেন। তৎকনিষ্ঠ বিক্রমাদিত্য বিদ্যানুরাগ নীতিপরতা ও শাস্ত্রানুশীলন দ্বারা বিশেষ বিখ্যাত ছিলেন তথাপি রাজ্যভোগের লোভসংবরণে অসমর্থ হইয়া জ্যেষ্ঠের প্রাণ সংহারপূর্ব্বক স্বয়ং রাজেশ্বর হইলেন এবং ক্রমে ক্রমে নিজ বাহুবলে সমস্ত দিগ্বিজয় করিয়া লক্ষযোজনবিস্তীর্ণ জম্বুদ্বীপের অধীশ্বর হইয়া আপন নামে অব্দ প্রচলিত করিলেন। কিয়দ্দিনান্তর রাজা মনে মনে বিবেচনা করিলেন জগদীশ্বর আমাকে নানা জনপদের অধিপতি করিয়া অসংখ্য প্রজাগণের হিতাহিতচিন্তার ভার দিয়াছেন। কিন্তু আমি আত্মসুখে নির্বৃত হইয়া তাহাদের অবস্থার প্রতি ক্ষণমাত্রও দৃষ্টিপাত করি না। কেবল অধিকৃতবর্গের বিবেচনার উপর নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত রহিয়াছি। তাহারা প্রজাগণের সহিত কিরূপ ব্যবহার করিতেছে অন্ততঃ এক বারও পরীক্ষা করিয়া দেখা উচিত। অতএব আমি প্রচ্ছন্ন বেশে দেশভ্রমণ করিয়া প্রজাগণের অবস্থা অবলোকন করিব। অনন্তর নিজ অনুজ ভর্ত্তৃহরির হস্তে সমস্ত সাম্রাজ্যের ভার সমর্পণ করিয়া স্বয়ং সন্ন্যাসীর বেশে দেশে দেশে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন।

উজ্জয়িনী নগরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ বহুকালাবধি তপস্যা করিতেছিলেন। এক দিন তিনি আপন উপাস্য দেবতার নিকট বরস্বরূপ এক অমরফল পাইয়া আনন্দিত মনে গৃহে আসিয়া ব্রাহ্মণীর নিকট কহিলেন দেখ দেবতা তপস্যায় তুষ্ট হইয়া আজি আমাকে এই ফল দিয়াছেন এবং কহিয়াছেন ইহা ভক্ষণ করিলে নর অমর হয়! ব্রাহ্মণী শুনিয়া অতিশয় খেদ করিয়া কহিলেন হায় অমর হইয়া আর কত কাল এ যন্ত্রণা ভোগ করিব। তুমি কি সুখে অমর হইবার অভিলাষ কর বুঝিতে পারি না। বরং এই দণ্ডে মৃত্যু হইলে সংসারের ক্লেশ হইতে পরিত্রাণ হয়।

গৃহিনীর এইরূপ বাক্যে হতবুদ্ধি হইয়া ব্রাহ্মণ কহিলেন আমি তৎকালে না বুঝিয়া দেবতার নিকট ফল লইয়াছিলাম এক্ষণে তোমার কোথা শুনিয়া আমার চৈতন্য হইল। এখন তুমি যেরূপ কহিবে তাহাই করিব। ব্রাহ্মণী কহিলেন এই ফল রাজা ভর্ত্তৃহরিকে দিয়া ইহার পরিবর্ত্তে পারিতোষিক স্বরূপ কিঞ্চিৎ অর্থ লইয়া আইস। তাহা হইলে অনায়াসে সংসারযাত্রা নির্বাহ করিয়া পরমার্থ-সাধনে যত্ন করিতে পারিবে।

ইহা শুনিয়া ব্রাহ্মণ রাজার নিকটে উপস্থিত হইলেন এবং যথাবিধি আশীর্বাদপ্রয়োগের পর দেবদত্ত ফলের গুণব্যাখ্যা ও পূর্ব্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া বিনয়পূর্ব্বক নিবেদন করিলেন মহারাজ আপনি এই ফল লইয়া আমাকে কিঞ্চিৎ অর্থ প্রদান করুন। আপনি চিরজীবী হইলে সমস্ত রাজ্যের মঙ্গল। রাজা ফল গ্রহণ করিয়া লক্ষ মুদ্রা প্রদানপূর্ব্বক ব্রাহ্মণকে বিদায় করিলেন এবং নিতান্ত স্ত্রৈণতা প্রযুক্ত মনে মনে বিবেচনা করিলেন যে ব্যক্তির চির জীবন ও স্থির যৌবন হইলে আমি যাবজ্জীবন সুখী হইব তাহাকেই এই ফল দেওয়া কর্ত্তব্য। অনন্তর অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া প্রেয়সী মহিষীর হস্তে ফল প্রদান করিলেন এবং করিলেন প্রিয়ে তুমি আমার জীবনসর্ব্বস্ব এই ফল খাও অমর হইবে ও চির কাল যুবতী থাকিবে। রাজ্ঞী ফল গ্রহণ করিলেন। রাজা প্রীত মনে সভায় প্রত্যাগমন করিয়া অমাত্যবর্গের সহিত রাজকার্য্য পর্য্যালোচনা করিতে লাগিলেন।

এক নগরপাল রাজমহিষীর প্রিয় পাত্র ছিল তিনি ঐ ফল তাহার হস্তে সমর্পণ করিলেন। কিন্তু নগরপাল এক বারাঙ্গনাকে অত্যন্ত ভাল বাসিত সে ঐ ফল তাহার হস্তে দিয়া অশেষপ্রকার গুণ বর্ণন করিল। বারাঙ্গনা ফল পাইয়া মনে মনে বিবেচনা করিল আমি অধম জাতি কুক্রিয়া দ্বারা উদরপূর্ত্তি করি আমার চিরজীবিনী হওয়া কেবল বিড়ন্বনামাত্র। অতএব এই ফল রাজাকে দেওয়া উচিত রাজা চিরজীবী হইলে অসংখ্য লোকের মঙ্গল হইবে। অনন্তর রাজার নিকটে গিয়া বিনয়পূর্ব্বক নিবেদন করিল মহারাজ আমি এই এক অপূর্ব্ব ফল পাইয়াছি ইহা ভক্ষণ করিলে নর অমর হয়। এই ফল আপনকার যোগ্য আপনি গ্রহণ করুন।

রাজা সেই অমরফল বারাঙ্গনার হস্তে দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন। কিন্তু তৎকালে সে ভাব গোপনে রাখিলেন এবং ফল লইয়া পুরস্কার প্রদানপূর্ব্বক তাহাকে বিদায় দিয়া ভাবিতে লাগিলেন এই ফল রাজ্ঞীকে দিয়াছি ইহা কি রূপে বারাঙ্গনার হস্তে আইল। পরে সবিশেষ অনুসন্ধান দ্বারা পূর্ব্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইলেন এবং সংসারের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বিবেচনা করিতে লাগিলেন এই সংসার অতি অকিঞ্চিৎকর ইহাতে সুখের লেশমাত্র নাই প্রত্যুত পরিণামে নিরয়গামী হইতে হয়। অতএব বৃথা মায়ায় মুগ্ধ হইয়া আর ইহাতে লিপ্ত থাকা কোন ক্রমেই শ্রেয়স্কর নহে। বরং ইহা পরিত্যাগ করিয়া অরণ্যে গিয়া জগদীশ্বরের আরাধনা করি চরমে পরম পুরুষার্থ মুক্তিপদার্থ লাভ করিতে পারিব।

অন্তঃকরণে এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া রাজা রাজ্ঞীকে জিজ্ঞাসিলেন তুমি সে ফল কি করিয়াছ। তিনি কহিলেন ভক্ষণ করিয়াছি। তখন রাজা সাতিশয় বিরাগ প্রদর্শনপূর্ব্বক রাণীকে সেই ফল দেখাইলেন। রাণী দৃষ্টিমাত্র হতবুদ্ধি ও স্তব্ধ হইয়া রহিলেন কিছুই উত্তর করিতে পারিলেন না। রাজা ভর্ত্তৃহরি অবিলম্বে অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া প্রক্ষালনপূর্ব্বক ফল ভক্ষণ করিলেন এবং রাজ্যাধিকার পরিত্যাগ করিয়া একাকী অরণ্য প্রবেশপুরঃসর যোগসাধনে প্রবৃত্ত হইলেন। বিক্রমাদিত্যের সিংহাসন শূন্য রহিল। দেবরাজ উজ্জয়িনীর অরাজক সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র এক যক্ষকে রক্ষক নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন। যক্ষ সতকতাপূর্ব্বক দিবারাত্র নগরীর রক্ষণাবেক্ষণ করিতে লাগিল। অল্প দিনের মধ্যেই দেশে বিদেশে প্রচার হইল রাজা ভর্ত্তৃহরি রাজত্ব পরিত্যাগ করিয়া বনপ্রস্থান করিয়াছেন। রাজা বিক্রমাদিত্য শ্রবণমাত্র অতিমাত্র ব্যগ্র হইয়া স্বদেশে প্রত্যাগমন করিলেন। তিনি অর্দ্ধরাত্র সময়ে নগরে প্রবেশ করিতেছেন এমন সময়ে নগররক্ষক যক্ষ আসিয়া নিষেধ করিয়া কহিল তুই কে কোথায় যাইতেছিস্‌ দাঁড়া তোর নাম কি বল্‌। রাজা কহিলেন আমি বিক্রমাদিত্য আপন নগরে যাইতেছি তুই কে কি নিমিত্ত আমাকে রোধ করিতেছিস্‌ বল্‌।

যক্ষ কহিল ত্রিদশাধিপতি ইন্দ্র আমাকে নগররক্ষার ভার দিয়া পাঠাইয়াছেন। তাঁহার অনুমতি ব্যতিরেকে আমি তোমাকে অসময়ে নগরে প্রবেশ করিতে দিব না। অথবা যদি তুমি যথার্থ রাজা বিক্রমাদিত্য হও অগ্রে আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর তবে নগরে যাইতে দিব। রাজা শ্রবণমাত্র বদ্ধপরিকর হইয়া যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হইলেন। যক্ষও তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত হইয়া তাঁহার সম্মুখীন হইল। ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল। পরিশেষে রাজা যক্ষকে ভূতলে ফেলিয়া তাহার বক্ষঃস্থলে আরোহণ করিয়া বসিলেন। তখন যক্ষ কহিল মহারাজ তুমি আমাকে পরাভব করিয়াছ। তোমার প্রভাব দেখিয়া বুঝিলাম তুমি যথার্থই রাজা বিক্রমাদিত্য। এক্ষণে আমাকে ছাড়িয়া দাও আমি তোমাকে প্রাণদান দিতেছি।

রাজা শুনিয়া হাস্য করিয়া কহিলেন তুই বাতুল নতুবা কি নিমিত্ত এমন অসঙ্গত বাক্য প্রয়োগ করিবি, তুই আমাকে প্রাণদান কি দিবি, আমি মনে করিলে এখনি তোর প্রাণদণ্ড করিতে পারি। যক্ষ শুনিয়া কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া কহিল মহারাজ যাহা কহিতেছ যথার্থ বটে। কিন্তু আমি তোমাকে আসন্ন মৃত্যু হইতে বাঁচাইতেছি। যাহা কহি অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। শুনিয়া তদনুসারে কার্য্য করিলে দীর্ঘজীবী হইয়া নিরুদ্বেগে অখণ্ড ভূমণ্ডলে একাধিপত্য করিতে পারিবে। তখন ভূপতি বিস্মিত ও ব্যগ্রচিত্ত হইয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। যক্ষও ক্ষণমধ্যে সমরশ্রান্তি পরিহার করিয়া বিক্রমাদিত্যকে সম্বোধিয়া অভিপ্রেত উপাখ্যানের উপক্রম করিল।

মহারাজ শ্রবণ কর

ভোগবতী নগরে চন্দ্রভানু নামে অতি প্রতাপশালী নরপতি ছিলেন। তিনি এক দিবস মৃগয়াবিলাষে কোন অটবীতে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলেন এক তপস্বী অধঃশিরাঃ বৃক্ষে লম্বমান ধূমপান করিতেছেন। অনেক অনুসন্ধানের পর তত্রত্যলোকমুখে অবগত হইলেন তপস্বী কাহারও সহিত বাক্যালাপ করেন না বহুকালাবধি একাকী এই ভাবে তপস্যা করিতেছেন। ফলতঃ রাজা সন্ন্যাসীর এইরূপ কঠোর ব্রত দর্শনে বিস্ময়াপন্ন হইয়া নগরে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। পর দিন যথাকালে রাজসভায় অধিষ্ঠান করিয়া কহিলেন হে অমাত্যবর্গ হে সভাসদগণ আমি গত কল্য মৃগয়ায় গিয়া বিপিনমধ্যে এক অদ্ভূত তপস্বী দেখিয়াছি। যদি কেহ তাঁহাকে রাজধানীতে আনিতে পারে তাহাকে লক্ষ্য মুদ্রা পারিতোষিক দিব।

এই রাজবাক্য নগরমধ্যে প্রচারিত হইলে এক প্রসিদ্ধ বারবনিতা নৃপতিসমীপে আসিয়া আবেদন করিল মহারাজ আজ্ঞা পাইলে আমি ঐ তপস্বীর ঔরসে পুত্ত্র জন্মাইয়া ঐ পুত্ত্র তাহার স্কন্ধে দিয়া আপনকার সভায় আনিতে পারি। রাজা শুনিয়া চমৎকৃত হইলেন এবং তাপসের আনয়নের নিমিত্ত পরম সমাদর পূর্ব্বক বারনারীকে বিদায় করিলেন। সে ভূপালের নিয়োগানুসারে যোগীর আশ্রমে উপস্থিত হইয়া দেখিল যোগী যথার্থই মুদ্রিতনয়ন অধঃশিরাঃ বৃক্ষে লম্বমান হইয়া ধূমপান করিতেছেন। অত্যন্ত শীর্ণদেহ কেহ কোন প্রশ্ন করিলে উত্তর দেন না। তদ্দর্শনে বারযোষিৎ সহসা সন্ন্যাসীর সমাধিভঙ্গ করা অসাধ্য জানিয়া সেই আশ্রমের অনতিদূরে এক সুশোভন উপবন ও তন্মধ্যে পরম রমণীয় হর্ম্ম্য নির্মাণ করাইল এবং নানা উপায় চিন্তিয়া পরিশেষে যুক্তিপূর্ব্বক মোহনভোগ প্রস্তুত করিয়া ধূমপায়ী তপস্বীর আস্যদেশে প্রদান করিল। তপস্বী রসনাসংযোগ দ্বারা মিষ্ট বোধ হওয়াতে ক্রমে ক্রমে সমুদায় ভক্ষণ করিলেন। বারাঙ্গনা পুনর্বার দিল তিনিও তৎক্ষণাৎ ভক্ষণ করিলেন।

এই রূপে ক্রমাগত কতিপয় দিবস মোহনভোগ উপযোগ করিয়া কিঞ্চিৎ সামর্থ্য বোধ হইলে সন্ন্যাসী নেত্রদ্বয় উন্মীলিত করিয়া তৰু হইতে অবতীর্ণ হইলেন এবং বারনারীকে জিজ্ঞাসিলেন তুমি কে কি অভিপ্রায়ে একাকিনী এই নির্জন বনস্থানে আগমন করিয়াছ। সে কহিল আমি দেবকন্যা দেবলোকে তপস্যা করি। সম্প্রতি মর্ত্ত্যলোকীয় তীর্থপর্য্যটন প্রসঙ্গে পরম পবিত্র কর্ম্মক্ষেত্র ভারতবর্ষে আসিয়া যোগানুষ্ঠানবাসনায় এক আশ্রম নির্মাণ করিয়াছি। নিয়ত তথায় অবস্থিত করি। অদ্য সৌভাগ্যক্রমে এই আশ্রমে প্রবেশ করিয়া আপনকার সন্দর্শন ও সম্ভাষণানুগ্রহ লাভ দ্বারা চরিতার্থতা প্রাপ্ত হইলাম। তপস্বী কহিলেন আমি তোমার সৌজন্য ও সুশীলতা দেখিয়া পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইয়াছি এবং তোমার সন্দর্শনে আত্মাকে চরিতার্থ বোধ করিতেছি। যে হেতু জন্মান্তরীণপুণ্যসঞ্চয় ব্যতিরেকে সাধুসমাগম লব্ধ হয় না। যাহা হউক আমি তোমার আশ্রমদর্শনের বাসনা করি। যদি প্রতিবন্ধক না থাকে ও সমধিক দূরবর্ত্তী না হয় আমাকে তথায় লইয়া চল।

বারবিলাসিনী তপস্বীর অভ্যর্থনা শুনিয়া কৃতার্থম্মন্য ও অতিমাত্র ব্যগ্র হইয়া তাঁহাকে আপন আলয়ে লইয়া গেল এবং অতি যত্ন ও পরম সমাদর পুরঃসর নানাবিধ সুস্বাদ মিষ্টান্ন ও সুরস পানীয় প্রদান করিল। তাপস বারনারীর কপট জালে বদ্ধ হইয়া তদ্দত্ত সমস্ত বস্তু ভক্ষণ ও পান করিলেন। এই রূপে ক্রমে ক্রমে ধূমপান পরিত্যাগপূর্ব্বক যোগাভ্যাসে জলাঞ্জলি দিয়া বারবনিতার সহিত বিষয়বাসনায় কালযাপন করিতে লাগিলেন। বারাঙ্গনা গর্ভবতী ও যথাকালে পুত্ত্রবতী হইল। কিয়ৎ দিন অতীত হইলে পর সে সন্ন্যাসীর নিকট নিবেদন করিল মহাশয় বহু দিবস অতিক্রান্ত হইল আমরা অনবরত কেবল বিষয়বাসনায় কালযাপন করিলাম। এক্ষণে তীর্থযাত্রা দ্বারা দেহ পবিত্র করা উচিত।

বারবনিতা এইরূপ প্রবঞ্চনা দ্বারা তপস্বীকে সংজ্ঞাশূন্য করিয়া তাঁহার স্কন্ধে পুত্ত্র প্রদানপূর্ব্বক চন্দ্রভানুর রাজধানী লইয়া চলিল। ক্রমে ক্রমে রাজসভার সন্নিধানে উপস্থিত হইলে রাজা বারাঙ্গনাকে দূর হইতে চিনিতে পারিয়া এবং সন্ন্যাসীর স্কন্ধে পুত্ত্র দেখিয়া সামাজিকদিগকে কহিলেন দেখ দেখ যে বারনারী যোগীর আনয়নবিষয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়া গিয়াছিল সে আপন প্রতিজ্ঞা পরিপূর্ণ করিয়া আসিতেছে। আমি উহার অসম্ভব বুদ্ধিকৌশলে চমৎকৃত হইয়াছি। অধিক কি কহিব এই বুদ্ধিমতী বারবনিতা চিরশুষ্ক নীরস তৰুকে পল্লবিত ও ফল পুষ্পে সুশোভিত করিয়াছে। সামাজিকেরা কহিলেন মহারাজ যথার্থ আজ্ঞা করিতেছেন এ সেই বারাঙ্গনাই বটে।

রাজা ও সভাসদগণের এইরূপ কথোপকথন শ্রবণে সন্ন্যাসীর সহসা বোধসুধাকরের উদয় হওয়াতে মোহান্ধকার নিরস্ত হইল। তখন তিনি পূর্ব্বাপর পর্য্যালোচনা করিয়া যৎপরোনাস্তি ক্ষোভ প্রাপ্ত হইলেন এবং আপনাকে বারংবার ধিক্কার দিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন দুরাত্মা চন্দ্রভানু ঐশ্বর্য্যমদে মত্ত ও ধর্ম্মাধর্ম্মজ্ঞানশূন্য হইয়া আমার তপস্যভ্রাংশের নিমিত্ত এই দুর্বিগাহ মায়াজাল বিস্তার করিয়াছিল। আমিও অতি অধম ও অবশেন্দ্রিয় অনায়াসে স্বৈরিণীর মায়ায় মুগ্ধ হইয়া চিরসঞ্চিত কর্ম্মফলে বঞ্চিত হইলাম। অনন্তর ক্রোধে কম্পান্বিতকলেবর হইয়া স্কন্ধস্থিত পুত্ত্রকে ভূতলে নিক্ষেপ করিয়া তৎক্ষণাৎ তথা হইতে প্রস্থান করিলেন এবং অন্য এক অরণ্যের মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক পূর্ব্বাপেক্ষায় সহস্রগুণ মনোযোগ ও অধ্যবসায় সহকারে যোগসাধন করিতে লাগিলেন এবং কিয়ৎ কাল পরে ঐ নরেশ্বরের মৃত্যুসাধন করিয়া কৃতকার্য্য হইলেন।

এই রূপে আখ্যায়িকা সমাপন করিয়া যক্ষ কহিল মহারাজ ইহার তাৎপর্য্য এই যে তুমি ও রাজা চন্দ্রভানু আর ঐ যোগী তিন জন এক নগরে এক নক্ষত্রে এক লগ্নে জন্মিয়াছিলে। তন্মধ্যে তুমি রাজবংশে জন্ম গ্রহণ করিয়া পৃথিবীর রাজত্ব করিতেছ। চন্দ্রভানু তৈলিকগৃহে জন্ম লইয়া ভোগবতী নগরীর অধিপতি হইয়াছিল। আর যোগী কুন্তকারকুলে উৎপন্ন হইয়া যত্নপূর্ব্বক যোগসাধন করিয়া চন্দ্রভানুর প্রাণবধ করিয়াছে এবং তাহাকে বেতাল করিয়া শ্মসানবর্ত্তী শিরীষবৃক্ষে লম্বিত করিয়া রাখিয়াছে। এক্ষণে অনন্যকর্ম্মা হইয়া কেবল তোমার প্রাণসংহারের চেষ্টা দেখিতেছে। তাহাতে কৃতকার্য্য হইলেই উহার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়। যদি তুমি তাহার হস্ত হইতে আত্মরক্ষা করিতে পার বহু কাল অকণ্টকে রাজ্যভোগ করিতে পারিবে। আমি তোমাকে সবিশেষ সকল কহিয়া সতর্ক করিয়া দিলাম তুমি এ বিষয়ে ক্ষণমাত্রও অসাবধান থাকিবে না।

এইরূপ উপদেশ দিয়া যক্ষ স্বস্থানে প্রস্থান করিল। রাজাও শুনিয়া ত্রস্ত ও বিস্ময়গ্রস্ত হইয়া নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে রাজবাটীতে প্রবিষ্ট হইলেন। পর দিন প্রভাতে তিনি সিংহাসনোপবিষ্ট হইলে ভৃত্যবর্গ ও প্রজাগণ বহু দিনের পর রাজসন্দর্শন লাভ করিয়া আনন্দপ্রবাহে মগ্ন হইল। রাজা বিক্রমাদিত্য রাজনীতির অনুবর্ত্তী হইয়া রাজ্যশাসন ও প্রজাপালন করিতে লাগিলেন।

কিয়ৎ দিন পরে শান্তশীল নামে এক সন্ন্যাসী শ্রীফল হস্তে রাজসভায় উপস্থিত হইলেন এবং ফল প্রদানপূর্ব্বক রাজাকে আশীর্বাদ করিয়া কক্ষস্থিত আসন পাতিয়া তদুপরি উপবেশন করিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ কথোপকথন করিয়া রাজার নিকট বিদায় লইয়া সন্ন্যাসী সভা হইতে প্রস্থান করিলে পর নরপতি অন্তঃকরণে এই বিতর্ক করিতে লাগিলেন যক্ষ যে সন্ন্যাসীর কথা কহিয়াছিল এ সেই ব্যক্তিই বা হয়। যাহা হউক সহসা এই ফল ভক্ষণ করা উচিত নহে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া কোষাধ্যক্ষের হস্তে প্রদান করিয়া কহিলেন তুমি এই ফল যত্নপূর্ব্বক রাখিবে। সন্ন্যাসী প্রত্যহ গমনাগমন ও ফলপ্রদান করিতে লাগিলেন।

এক দিবস রাজা বয়স্যবর্গসমভিব্যাহারে মন্দুরাসন্দর্শনার্থ গমন করিয়াছিলেন। সেই সময়ে সন্ন্যাসীও তথায় উপস্থিত হইয়া পূর্ব্ববৎ ফল প্রদানপূর্ব্বক আশীর্বাদ করিলেন। দৈবযোগে ঐ ফল ভুপতির করতল হইতে ভূতলে পতিত ও ভগ্ন হওয়াতে তন্মধ্য হইতে এক অপূর্ব্ব রত্ন নির্গত হইল। রাজা ও রাজবয়স্যগণ তদীয়প্রভাদর্শনে চমৎকৃত হইলেন। রাজা যোগীকে জিজ্ঞাসা করিলেন মহাশয় আপনি কি জন্যে আমাকে এই রত্নগর্ভ ফল দিলেন।

যোগী কহিলেন মহারাজ শাস্ত্রে রাজা গুরু জ্যোতির্বিদ ও চিকিৎসকের নিকট রিক্ত হস্তে যাইতে নিষেধ আছে। এই জন্যে আমি এই রত্নগর্ভ ফল লইয়া আসিয়াছিলাম। আর এক রত্নগর্ভ ফলের কথা কি কহিতেছেন প্রতিদিন আপনাকে যে যে ফল দিয়াছি সকলের মধ্যেই এতাদৃশ এক এক রত্ন আছে। তখন রাজা কোষাধ্যক্ষকে ডাকাইয়া কহিলেন তোমাকে যত শ্রীফল রাখিতে দিয়াছি সমূদয় আনয়ন কর। কোষাধ্যক্ষ রাজার আদেশানুসারে সমস্ত ফল আনয়ন করিল। রাজা প্রত্যেক ফল ভাঙ্গিয়া সকলের মধ্যেই এক এক রত্ন দেখিয়া অত্যন্ত আহ্লাদিত হইলেন এবং তৎক্ষণাৎ রাজসভায় আগমনপূর্ব্বক এক মণিকারকে ডাকাইয়া রত্নের পরীক্ষা করিতে আজ্ঞা দিয়া কহিলেন এই অসার সংসারে ধর্ম্মই সার পদার্থ অতএব তুমি ধর্ম্মপ্রমাণ প্রত্যেক রত্নের মূল্য নিরূপণ করিয়া দাও।

এইরূপ রাজবাক্য শ্রবণ করিয়া মণিকার কহিল মহারাজ আপনি যথার্থ আজ্ঞা করিয়াছেন। ধর্ম্ম রক্ষা করিলে সকল রক্ষা হয় ধর্ম্ম লোপ করিলে সকল লোপ হয়। অতএব আমি ধর্ম্ম সাক্ষী করিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছি আপন জ্ঞান অনুসারে যথার্থ মূল্য নিরূপণ করিয়া দিব। ইহা কহিয়া প্রত্যেক রত্নের লক্ষণ পরীক্ষা করিয়া কহিল মহারাজ বিলক্ষণ বিবেচনা করিয়া দেখিলাম সকল মণিই সর্ব্বাঙ্গসুন্দর কোটি মুদ্রাও একৈকের প্রকৃত মূল্য নহে। এ সকল অমূল্য রত্ন।

রাজা শুনিয়া অতিশয় হৃষ্ট হইয়া সমুচিত পারিতোষিক প্রদানপূর্ব্বক মণিকারকে বিদায় করিলেন এবং হস্ত দ্বারা সন্ন্যাসীর হস্ত গ্রহণ করিয়া সিংহাসনার্দ্ধে উপবেশন করাইয়া কহিলেন মহাশয় আমার সমস্ত সাম্রাজ্যও আপনকার এক রত্নের তুল্যমূল্য হইবেক না। আপনি সন্ন্যাসী হইয়া এই সকল অমূল্য রত্ন কোথায় পাইলেন এবং কি অভিপ্রায়েই বা আমাকে দিলেন জানিতে ইচ্ছা করি। যোগী কহিলেন মহারাজ মন্ত্রণা ঔষধ গৃহচ্ছিদ্র এ সকল সর্ব্বসমক্ষে ব্যক্ত করা বিধেয় নহে। যদি অনুমতি হয় নির্জনে গিয়া নিবেদন করি। মহারাজ, নীতিজ্ঞেরা কহেন মন্ত্রণা ষট্‌ কর্ণে প্রবিষ্ট হইলে অপ্রকাশিত থাকে না, তাহাতে কার্য্যহানির সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। চারি কর্ণে হইলে প্রকাশিত হয় না অথচ কার্য্যসিদ্ধি করে। আর দুই কর্ণের মন্ত্রণা মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক ব্রহ্মাও জানিতে পারেন না।

ইহা শুনিয়া রাজা সন্ন্যাসীকে নির্জনে লইয়া কহিতে লাগিলেন হে যোগীশ্বর আপনি আমাকে এত রত্ন দিলেন কিন্তু এক দিনও আমার আলয়ে ভোজন বা জলগ্রহণ করিলেন না, ইহাতে আমি আপনকার নিকট অত্যন্ত লজ্জিত হইতেছি। যদি আপনকার কোন অভিপ্রায় থাকে ব্যক্ত কৰুন আমি প্রাণান্তেও তৎসম্পাদনে পরাঙ্মুখ হইব না। সন্ন্যাসী কহিলেন মহারাজ গোদাবরীতীরস্থিত শ্মশানে মন্ত্র সিদ্ধ করিবার বাসনা করিয়াছি তাহাতে অষ্টসিদ্ধি লাভ হইবেক। অতএব তোমার নিকট এই প্রার্থনা করিতেছি তুমি এক দিন সন্ধ্যা অবধি প্রভাত পর্য্যন্ত আমার সন্নিহিত থাকিবে। তুমি সন্নিহিত থাকিলেই আমার মন্ত্র সিদ্ধ হইবেক। রাজা কহিলেন আমি নিঃসন্দেহ যাইব আপনি দিন নির্ণয় করিয়া বলুন। সন্ন্যাসী কহিলেন তুমি আগামী ভাদ্র কৃষ্ণচতুর্দশীতে সন্ধ্যাকালে একাকী আমার নিকটে যাইবে। রাজা কহিলেন আপনি নিশ্চিন্ত থাকিবেন আমি অবশ্য যাইব। এই রূপে রাজাকে বচনবদ্ধ করিয়া বিদায় লইয়া সন্ন্যাসী আপন আশ্রমে প্রস্থান করিলেন।

নির্দ্ধারিত কৃষ্ণ চতুর্দশী উপস্থিত হইল। সন্ন্যাসী সায়ং সময়ে সমুদয় সংগ্রহপূর্ব্বক শ্মশানে যোগাসনে বসিলেন। রাজা বিক্রমাদিত্যও প্রতিশ্রুত সময় সমুপস্থিত জানিয়া সাহসে নির্ভর করিয়া করে তরবারি ধারণপূর্ব্বক একাকী সন্ন্যাসীর নিকট উপস্থিত হইলেন। তিনি ইতস্ততঃ দৃষ্টিসঞ্চারণ করিয়া দেখিতে লাগিলেন নানাপ্রকার আকারবিশিষ্ট ভূত প্রেত পিশাচ শঙ্খিনী ডাকিনীগণ বিকট হাস্য করিয়া চতুর্দিকে নৃত্য করিতেছে আর যোগী তাহাদের মধ্যে বসিয়া দুই হন্তে দুই কপাল লইয়া বাদ্য করিতেছেন। রাজা এতাদৃশ ভয়ানক ব্যাপার দর্শনে কিঞ্চিন্মাত্রও ভীত হইলেন না বরং যোগীকে প্রণাম করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন মহাশয় ভৃত্য উপস্থিত, আদেশ দ্বারা চরিতার্থ করিতে আজ্ঞা হয়। যোগী কহিলেন এই আসনে উপবেশন কর।

রাজা যোগীর আজ্ঞানুসারে আসনপরিগ্রহ করিয়া কিয়ৎ ক্ষণ পরে পুনর্বার নিবেদন করিলেন মহাশয় আমার প্রতি কি আজ্ঞা হয়। যোগী কহিলেন মহারাজ তোমার বাক্যনিষ্ঠায় অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি। অথবা সৎপুৰুষেরা প্রাণান্তেও প্রতিজ্ঞাপ্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হয়েন না। যাহা হউক যদি অনুগ্রহ করিয়া আসিয়াছ আমার এক সাহায্য কর। দুই ক্রোশ দক্ষিণে এক শ্মশান আছে। তথায় গিয়া দেখিবে এক শিরীষবৃক্ষে শব ঝুলিতেছে। তুমি ঐ শব আমার নিকটে লইয়া আইস আমি ইতিমধ্যে পূজার আয়োজন করিতেছি। রাজা যথা আজ্ঞা বলিয়া তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিলেন সন্ন্যাসীও রাজাকে শবানয়নে প্রেরণ করিয়া পূজায় বসিলেন।

একে কৃষ্ণচতুর্দশীরাত্রি সহজেই ঘোরতর অন্ধকারে আবৃত তাহাতে ঘনঘণ্টা দ্বারা গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন হইয়া মুষলধারায় বৃষ্টি হইতেছিল আর ভূতপ্রেতগণ চতুর্দিকে ভয়ানক কোলাহল করিতেছিল। এইরূপ সঙ্কটে কাহার হৃদয়ে না ভয়সঞ্চার হয়। কিন্তু রাজার তাহাতে ভয় বা ব্যাকুলতার লেশমাত্রও উপস্থিত হইল না। পরিশেষে নানা সঙ্কট হইতে উত্তীর্ণ হইয়া প্রেতভূমিতে উপনীত হইলেন। দেখিলেন কোন স্থলে বিকটমূর্ত্তি ভূত সকল জীবিত মনুষ্য ধরিয়া তাহাদের প্রাণ সংহার করিতেছে। কোন স্থলে ডাকিনীগণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালক ধরিয়া চর্ব্বণ করিতেছে। অনন্তর ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিয়া শিরীষবৃক্ষের নিকটে গিয়া দেখিলেন ইহার মূল অবধি অগ্রভাগ পর্য্যন্ত প্রত্যেক বিটপ ও পল্লব ধক্‌ ধক্‌ করিয়া জ্বলিতেছে আর চারি দিকে অনবরত কেবল মার্‌ মার্‌ ধর্‌ ধর্‌ ইত্যাদি ভয়ানক শব্দ হইতেছে।

এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া রাজা ভয় পাইলেন না। কিন্তু মনে মনে বিবেচনা করিয়া স্থির করিলেন যক্ষ যে সন্ন্যাসীর কথা কহিয়াছিল এ অবশ্যই সেই ব্যক্তি হইবে। পরে ক্রমে ক্রমে বৃক্ষের অত্যন্ত সন্নিহিত হইয়া দেখিলেন শব রজ্জুবদ্ধ অধঃশিরাঃ লম্বমান আছে। রাজা শবদর্শনে শ্রম সফল বোধ করিয়া অত্যন্ত আহ্লাদিত হইলেন এবং নির্ভয়ে বৃক্ষে আরোহণপূর্ব্বক খড়্গাঘাত দ্বারা বন্ধনরজ্জুচ্ছেদন করিলেন। শব ভূতলে পতিত হইবামাত্র উচ্চৈঃ স্বরে রোদন করিতে লাগিল। রাজা তাহার কণ্ঠশব্দশ্রবণে সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন এবং ত্বরায় তৰু হইতে অবতীর্ণ হইয়া নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসিলেন তুমি কে, কি নিমিত্ত তোমার এরূপ দুরবস্থা ঘটিয়াছে বল। সে শুনিবামাত্র খিল্‌ খিল্‌ করিয়া হাসিয়া উঠিল। রাজা দেখিয়া শুনিয়া অত্যন্ত বিস্ময়াপন্ন ও চিন্তান্বিত হইলেন এবং এই অদ্ভুত ব্যাপারে মর্ম্মাববোধে অসমর্থ হইয়া অশেষপ্রকার কল্পনা করিতে লাগিলেন।

এই অবসরে শব বৃক্ষে উঠিয়া পূর্ব্ববৎ রজ্জুবদ্ধ ও লম্বমান হইয়া রহিল। রাজাও তৎক্ষণাৎ বৃক্ষে আরোহণ ও রজ্জুচ্ছেদন পুরঃসর শবকে কক্ষে নিক্ষিপ্ত করিয়া অবতীর্ণ হইলেন এবং সাতিশয় নির্বন্ধ সহকারে তাহার এরূপ বিপৎপ্রাপ্তির কারণ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। সে কিছুই উত্তর দিল না। রাজা ক্ষণ কাল চিন্তা করিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন যক্ষের নিকট যে তৈলিকের কথা শুনিয়াছিলাম সে এই ব্যক্তি আর যোগীও সেই কুম্ভকার আপন যোগসিদ্ধির উদ্দেশে ইহার প্রাণসংহার করিয়া শ্মশানে রাখিয়াছে। অনন্তর তাহাকে উত্তরীয়বস্ত্রে বন্ধন করিয়া যোগীর নিকট লইয়া চলিলেন।

অর্দ্ধপথে উপস্থিত হইলে শবাবিষ্ট বেতাল বিক্রমাদিত্যকে জিজ্ঞাসিল অহে বীরপুরুষ তুমি কে আমাকে কোথায় লইয়া যাও। ভূপতি কহিলেন আমি রাজা বিক্রমাদিত্য শান্তশীলনামক যোগীর আজ্ঞানুসারে তোমাকে তাঁহার আশ্রমে লইয়া যাইতেছি। বেতাল কহিল মহারাজ মূঢ় দুর্বুদ্ধি ও অলসেরাকেবল নিদ্রা আলস্য ও কলহে কালহরণ করে। কিন্তু বুদ্ধিমান্‌ চতুর ও পণ্ডিত ব্যক্তিদিগের সদা সদালাপ সৎকর্ম্মের অনুষ্ঠান ও শাস্ত্রচিন্তা দ্বারা আনন্দে কালযাপন হয়। অতএব সমস্ত পথ মৌন ভাবে গমন করা অপেক্ষা সৎকথার আলোচনা শ্রেয়সী বোধ করিয়া এক এক প্রসঙ্গ করিতেছি শ্রবণ কর। আমি প্রত্যেক প্রসঙ্গের পরিশেষে প্রশ্ন করিব যদি তুমি তত্তৎ প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর দাও তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া যাইব। আর যদি জানিয়াও যথার্থ উত্তর না দাও অবিলম্বে তোমার বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ ও অন্তে নরকপাত হইবেক। রাজা অগত্যা তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া তাহাকে সন্ন্যাসীর আশ্রমে লইয়া চলিলেন এবং বেতালও উপাখ্যান আরম্ভ করিল।