পাতা:গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২১৭

উইকিসংকলন থেকে
পরিভ্রমণে চলুন অনুসন্ধানে চলুন
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৪২৮
গল্পগুচ্ছ

 গল্পগুচ্ছ একদিন সামান্য কারণে বিষ উদ্গীরিত হইয়া পড়িল। স্ত্রীর কাছে পরমানন্দকে উল্লেখ করিয়া ‘দুশ্চরিত্র ভণ্ড’ বলিয়া গালি দিলেন এবং কহিলেন, “তােমার শালগ্রাম স্পর্শ করিয়া শপথপূর্বক বলো দেখি, সেই বকধার্মিককে তুমি মনে মনে ভালােবাস না।”

 দলিত ফণিনীর ন্যায় মুহুর্তের মধ্যেই উদগ্র হইয়া মিথ্যা স্পর্ধা দ্বারা স্বামীকে বিদ্ধ করিয়া গৌরী রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “ভালােবাসি, তুমি কী করিতে চাও করাে!” পরেশ তৎক্ষণাৎ ঘরে তালাচাবি লাগাইয়া তাহাকে রুদ্ধ করিয়া আদালতে চলিয়া গেল।

 অসহ্য রােষে গৌরী কোনােমতে দ্বার উন্মােচন করাইয়া তৎক্ষণাৎ বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল।

 পরমানন্দ নিভৃত ঘরে জনহীন মধ্যাহ্নে শাস্ত্রপাঠ করিতেছিলেন। হঠাৎ অমেঘবাহিনী বিদ্যুল্লতার মতাে গৌরী ব্রাহ্মচারীর শাস্ত্রধ্যয়নের মাঝখানে আসিয়া ভাঙিয়া পড়িল।

 গুরু কহিলেন, “এ কী।”

 শিষ্য কহিল, “গুরুদেব, অপমানিত সংসার হইতে আমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া চলো, তােমার সেবাব্রতে আমি জীবন উৎসর্গ করিব।”।

 'পরমানন্দ কঠোর ভৎসনা করিয়া গৌরীকে গৃহে ফিরিয়া পাঠাইলেন। কিন্তু, হায় গুররদেব, সেদিনকার সেই অকস্মাৎ ছিন্নবিচ্ছিন্ন অধ্যয়নসত্র আর কি তেমন করিয়া জোড়া লাগিতে পারিল।

 পরেশ গহে আসিয়া মুক্তদ্বার দেখিয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানে কে আসিয়াছিল।”

 স্ত্রী কহিল, “কেহ আসে নাই, আমি গুরুদেবের গহে গিয়াছিলাম।”

 পরেশ মহতকাল পাংশু এবং পরক্ষণেই রক্তবর্ণ হইয়া কহিলেন, “কেন গিয়াছিলে।”

 গৌরী কহিল, “আমার খুশি।”

 সেদিন হইতে পাহারা বসাইয়া স্ত্রীকে ঘরে রন্ধে করিয়া পরেশ এমনি উপদ্রব আরম্ভ করিলেন যে, শহরময় কুৎসা রটিয়া গেল।

 এই-সকল কুৎসিত অপমান ও অত্যাচারের সংবাদে পরমানন্দের হরিচিন্তা দূরে হইয়া গেল। এই নগর অবিলম্বে পরিত্যাগ করা তিনি কর্তব্য বােধ করিলেন অথচ উৎপীড়িতকে ফেলিয়া কোনােমতেই দরে যাইতে পারিলেন না।সন্ন্যাসীর এই কয়দিনকার দিনরাত্রের ইতিহাস কেবল অন্তর্যামীই জানেন।

 অবশেষে অবরােধের মধ্যে থাকিয়া গৌরী একদিন পত্র পাইল, “বৎসে, আলােচনা করিয়া দেখিলাম, ইতিপূর্বে অনেক সাধী সাধকরমণী কৃষ্ণপ্রেমে সংসার ত্যাগ করিয়াছেন। যদি সংসারের অত্যাচারে হরিপাদপদ্ম হইতে তােমার চিত্ত বিক্ষিপ্ত হইয়া থাকে তবে জানাইলে ভগবানের সহায়তায় তাঁহার সেবিকাকে উদ্ধার করিয়া প্রভুব অভয় পদারবিন্দে উৎসর্গ করিতে প্রয়াসী হইব। ২৬শে ফাগুন বুধবারে অপরাহু ২ ঘটিকার সময় ইচ্ছা করিলে তােমাদের পুষ্করিণীতীরে আমার সহিত সাক্ষাৎ হইতে পারিবে।”

 গৌরী পত্রখানি কেশে বাঁধিয়া খোঁপার মধ্যে ঢাকিয়া রাখিল। ২৬শে ফাগুন