পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৫৬
গল্পগুচ্ছ

দেখাইয়া দাও।”

 কোনাে উত্তর পাইল না।

 তখন মত্যুঞ্জয় যষ্টির উপর ভর করিয়া হাৎড়াইয়া সুরঙ্গ হইতে বাহির হইবার চেষ্টা করিল। কিন্তু, পথ অত্যন্ত জটিল, গােলকধাঁধার মতাে, বার বার বাধা পাইতে লাগিল। অবশেষে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ক্লান্ত হইয়া এক জায়গায় শুইয়া পড়িল এবং নিদ্রা আসিতে বিলম্ব হইল না।

 ঘুম হইতে যখন জাগিল তখন রাত্রি কি দিন কি কত বেলা তাহা জানিবার কোনাে উপায় ছিল না। অত্যন্ত ক্ষুধা বােধ হইলে মত্যুঞ্জয় চাদরের প্রান্ত হইতে চিঁড়া খুলিয়া লইয়া খাইল। তাহার পর আর-একবার হাৎড়াইয়া সুরঙ্গ হইতে বাহির হইবার পথ খুঁজিতে লাগিল। নানা স্থানে বাধা পাইয়া বসিয়া পড়িল। তখন চীৎকার করিয়া ডাকিল, “ওগাে সন্ন্যাসী, তুমি কোথায়।”

 তাহার সেই ডাক সুরঙ্গের সমস্ত শাখা প্রশাখা হইতে বারবার প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। অনতি দূর হইতে উত্তর আসিল, “আমি তােমার নিকটেই আছি—কী চাও বলাে।”

 মৃত্যুঞ্জয় কাতর স্বরে কহিল, “কোথায় ধন আছে আমাকে দয়া করিয়া দেখাইয়া দাও।”

 তখন আর-কোনাে সাড়া পাওয়া গেল না। মৃত্যুঞ্জয় বারম্বার ডাকিল, কোনাে সাড়া পাইল না।

 দণ্ড প্রহরের দ্বারা অবিভক্ত এই ভূতলগত চিররাত্রির মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় আর-একবার ঘুমাইয়া লইল। ঘুম হইতে আবার সেই অন্ধকারের মধ্যে জাগিয়া উঠিল। চীৎকার করিয়া ডাকিল, “ওগাে, আছ কি।”

 নিকট হইতেই উত্তর পাইল, “এইখানেই আছি। কী চাও।”

 মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “আমি আর-কিছু চাই না আমাকে এই সুরঙ্গ হইতে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাও।”

 সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি ধন চাও না?”

 মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “না, চাহি না।”

 তখন চক্‌মকি ঠোকার শব্দ উঠিল এবং কিছুক্ষণ পরে আলাে জ্বলিল।

 সন্ন্যাসী কহিলেন, “তবে এসো মত্যুঞ্জয়, এই সুরঙ্গ হইতে বাহিরে যাই।”

 মত্যুঞ্জয় কাতর স্বরে কহিল, “বাবা, নিতান্তই কি সমস্ত ব্যর্থ হইবে। এত কষ্টের পরেও ধন কি পাইব না।”

 তৎক্ষণাৎ মশাল নিবিয়া গেল। মত্যুঞ্জয় কহিল, “কি নিষ্ঠুর।” বলিয়া সেইখানে বসিয়া পড়িয়া ভাবিতে লাগিল। সময়ের কোনাে পরিমাণ নাই, অন্ধকারের কোনো অন্ত নাই। মৃত্যুঞ্জয়ের ইচ্ছা করিতে লাগিল, তাহার সমস্ত শরীর-মনের বলে এই অন্ধকারটাকে ভাঙিয়া চূর্ণ করিয়া ফেলে। আলােক আকাশ আর বিশ্বচ্ছবির বৈচিত্র্যের জন্য তাহার প্রাণ ব্যাকুল হইয়া উঠিল; কহিল, “ওগাে সন্ন্যাসী, ওগাে নিষ্ঠুর সন্ন্যাসী, আমি ধন চাই না, আমাকে উদ্ধার করাে।”

 সন্ন্যাসী কহিলেন, “ধন চাও না? তবে আমার হাত ধরো। আমার সঙ্গে চলাে।”

 এবারে আর আলাে জ্বলিল না। এক হাতে যষ্টি ও এক হাতে সন্ন্যাসীর উত্তরীয়