পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৮০

উইকিসংকলন থেকে
পরিভ্রমণে চলুন অনুসন্ধানে চলুন
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(?8 বিভূতি রচনাবলী বিছানার উপর ছড়াইয়া ফেলিয়া পুনরায় সেগুলা বাক্সে সাজাইতে লাগিল। কি জানি কেন অপুর মনে হইল, এই ব্যাপারেই তাহার চরম পৌরুষ দেখানো হইবে। মেয়েটি দাড়াইয় দেখিতে লাগিল, কোনো কথা বলিল না, অপুও কোনো কথা বলিল না। আলাপ হইল সেদিন সন্ধ্যায়। সে স্কুল হইতে আসিয়া সবে দাড়াইয়াছে, মেয়েটি আসিয়া লাজুক চোখে বলিল—আপনাকে মা খাবার খেতে ডাকচেন । আসন পাতা-পরোটা, বেগুন ভাজা, আলু চচ্চড়ি, চিনি। অপু চিনি পছন্দ করে না, গুড়ের মত জিনিস নাই, কেন ইহার এমন মুন্দর গরম গরম পরোটা চিনি দিয়া খায় ?. মেয়েটি কাছে দাড়াইয়া ছিল । বলিল—মীকে বলব আর দিতে ? --না ; তোমরা চিনি খাও কেন ?.গুড় তো ভাল— মেয়েটি বিস্মিতযুখে বলিল—কেন, আপনি চিনি খান না ? —ভালবাসি নে—রুগীর খাবার—খেজুরে গুড়ের মত কি আর খেতে ভাল ?—মেয়েটির সামনে তাহার আদে লজ্জা ছিল না, কিন্তু এই সময়ে মহিলাটি ঘরে ঢোকাতে অপুর লম্বা লম্বা কথা বন্ধ হইয়া গেল। মহিলাটি বলিলেন—ওকে দাদা ব'লে ডাকবি নির্মলা, কাছে বসে খাওয়াতে হবে রোজ। ও দেখছি যে-রকম লাজুক, এ পর্যন্ত তো আমার সঙ্গে একটা-কথাও বললে না—না দেখলে আধপেট খেয়ে উঠে যাবে! অপু লজ্জিত হইল ; মনে মনে ভাবিল ইহাকে সে মা বলিয়া ডাকিবে। কিন্তু লজ্জার পারিল না, সুযোগ কোথায় ? এমনি খামক মা বলিয়া ডাকা—সে বড়—সে তাহ পরিবে না। মাসখানেক ইহাদের বাড়ি থাকিতে থাকিতে অপুর কতকগুলি নতুন বিষয়ে জ্ঞান হইল। সবাই ভারী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, আটপৌরে পোশাকপরিচ্ছদও মুদৃপ্ত ও মুরুচিসম্মত। মেয়েদের শাড়ি পরিবার ধরণটি বেশ লাগে, একে সবাই দেখিতে মুত্র, তাহার উপর মুদৃপ্ত শাড়ি-সেমিজে আরও মুন্দর দেখায়। এই জিমিসটা অপু কখনও জানিত না, বড়লোকের বাড়ি থাকিবার সময়ও নহে, কারণ সেখানে ঐশ্বর্ষের আড়ম্বরে তাহার অনভ্যস্ত চক্ষু ধাধিয়া গিয়াছিল—সহজ গৃহস্থ জীবনের দৈনন্দিন ব্যাপারের পর্যারে তাহাকে লে ফেলিতে পারে নাই। অপু যে-সমাজ, যে-আবহাওয়ায় মানুষ—সেখানকার কেহ এ ধরণের সহজ সৌন্দর্যময় জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত নয়। নানা জায়গায় বেড়াইয়া নানা ধরণের লোকের সঙ্গে মিশিয়া তাহার আজকাল চোখ ফুটিয়াছে ; সে আজকাল বুঝিতে পারে নিশ্চিনিপুরে তাহদের গৃহস্থালী ছিল দরিত্রের, অতি দরিদ্রের গৃহস্থালী। শিল্প নয়, ঐ ছাদ নয়, সৌন্দৰ নয়, শুধু খাওয়া আর থাকা। নির্মলা আসিয়া কাছে বসিল । অপু অ্যালজেব্রার শক্ত আঁক কষিতেছিল, নির্মলা নিজের বইখানা খুলিয়া বলিল—আমার ইংরেজিটা একটু ব’লে দেবেন দাদা ! অপু বলিল—এসে জুটলে ? এখন ওসব হবে না, ভারী মুশকিল, একটা অঁকিও সকাল থেকে মিললো না। নির্মলা নিজে বসিয়া পড়িতে লাগিল। সে বেশ ইংরেজি জানে, তাহার বাবা বা করিয়া শিখাইয়াছেন, বাংলাও খুব ভাল জামে ।