পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

X ი\ყ বিভূতি-রচনাবলী অপুর মন বেজায় দমিয়া গেল। এই অন্ধকার স্কুলঘরটার, দরিদ্র্য, এই ত্রিকালোত্তীর্ণ বুদ্ধগণের মুখের একটা বুদ্ধিহীন সন্তোষের ভাব ও মনের স্থবিরত্ব, ইহাদের সাহচর্য হইতে তাহাকে দূরে হটাইয়া লইতে চাহিল! যাহা জীবনের বিরোধী, আনন্দের বিরোধী, সর্বোপরি—তাহার অস্থিমজ্জাগত যে রোমাঞ্চের তৃষ্ণ—তাহার বিরোধী, অপু সেখানে একদণ্ড তিষ্ঠিতে পারে না । ইহারা বৃদ্ধ বলিয়া যে এমন ভাব হইল অপুর, তাহা নয়, ইহাদের অপেক্ষাও বৃদ্ধ ছিলেন শৈশবের সঙ্গী নরোত্তম দাস বাবাজী। কিন্তু সেখানে সদাসর্বদা একটা মুক্তির হাওয়া বহিত, কাশীর কথকঠাকুরকেও এইজন্যই ভাল লাগিয়াছিল। অসহায়, দরিদ্র বৃদ্ধ একটা আশাভর আনন্দের বাণী বহন করিয়া আনিয়াছিলেন তাহার মনে—যেদিন জিনিসপত্র বাধিয়া হাসিমুখে নতুন সংসার বাধিবার উৎসাহে রাজঘাটের স্টেশনে ট্রেনে চড়িয়া দেশে রওনা হইয়াছিলেন। স্কুল হইতে যখন সে বাহির হইল, বেলা প্রায় গিয়াছে। ৩াহার কেমন একটা ভয় হইল— এ ভয়টা এতদিন হয় নাই। না খাইয়া থাকিবার বাস্তবতা ইতিপূর্বে এভাবে কখনও নিজের জীবনে সে অনুভব করে নাই—বিশেষ করিয়া যখন এখানে খাইতে-পাওয়া নির্ভর করিতেছে নিজের কিছু একটা খুজিয়া বাহির করিবার সাফল্যের উপর। কিন্তু তাহার সকলের চেয়ে দুর্ভাবনা মায়ের জন্ত । একটা পয়সা সে মাকে পাঠাইতে পারিল না, আজ এতদিন মা পত্র দিয়াছে—কি করিয়া চলিতেছে মায়ের -- কিন্তু এখানে তো কোনও কিছু আশা দেখা যায় না—এত বড় কলিকাতা শহরে পাড়াগায়ের ছেলে, সহায় নাই, চেনাশোনো নাই, সে কোথায় যাইবে—কি করিবে ?. পথে একটা মাড়োয়ারীর বাড়িতে বোধ হয় বিবাহ। সন্ধ্যার তখনও সামান্ত বিলম্ব আছে, কিন্তু এরই মধ্যে সামনের লাল-নীল ইলেক্‌টিক আলোর মালা জালাইয়া দিয়াছে, দু’চারখানা মোটর ও জুড়িগাড়ি আসিতে শুরু করিয়াছে। লুচি-ভাজার মন-মাতানো মুগন্ধে বাড়ির সামনেটা ভরপুর। হঠাৎ অপু দাড়াইয়া গেল। ভাবিল—যদি গিয়ে বলি আমি একজন পুওর স্টডেণ্ট—সারাদিন খাই নি—তবে খেতে দেবে না –ঠিক দেবে—এত বড় লোকের বাড়ি, কত লোক তো খাবে—বলতে দোষ কি ? কে-ই বা চিনবে আমায় এখানে ?. কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিল না। সে বেশ বুঝিল, মনে ষোল আনা ইচ্ছা থাকিলেও মুখ দিয়া একথা সে বলিতে পারিবে না কাহারও কাছে—লজ্জা করিবে। লজ্জা না করিলে সে যাইত । মুখচোরা হওয়ার অসুবিধা সে জীবনে পদে পদে দেখিয়া আসিতেছে।... কলিকাতা ছাড়িয়া মনসাপোতা ফিরিবে ? কথাটা সে ভাবিতে পারে না—প্রত্যেক রক্তবিষ্ণু বিদ্রোহী হইরা ওঠে। তাহার জীবন-সন্ধানী মন তাহাকে বলিয়া দেয় এখানে জীবন, আলো, পুষ্ট, প্রসারতী—সেখানে অন্ধকার, দৈন্ত, নিভিয়া যাওয়া। কিন্তু উপায় কই তাহার হাতে ? সে তো চেষ্টার ক্রটি করে নাই। সব দিকেই গোলমাল। কলেজের মাছিনা না দিলে, আপাততঃ পরীক্ষা দিতে দিলেও, বেতন শোধ না করিলে প্রমোশন বন্ধ। খাকিবার স্বানের এই দশা, দু'বেল ওষুধের কারখানার ম্যানেজার উঠিয়া যাইবার তাগিদ দেয়, আহার তথৈবচ, স্বক্ষয়-ঠাকুরের দেন, মায়ের কষ্ট—একেই তো সেসংসারানভিজ্ঞ, স্বপ্নদর্শী প্রকৃতির