পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨છે8 বিভূতি-রচনাবলী সংগ্রহ করে কি। পাহারা দেবার জন্তে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বোট ও স্টীমলঞ্চ সব সময় মুন্দরবনের নদী, খাড়ি ও খালের মধ্যে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিত। কতবার আমি কাকার সঙ্গে এই সরকারী বোটে সুন্দরবনের মধ্যে বেড়াতে গিয়েছি! আমার মনে এই সুন্দরবনের একটা অপূর্ব স্বপ্নছবি মুদ্রিত আছে। তখন আমি ছেলেমানুষ, সবে তেরো—শহর থেকে গিয়েছি। সুন্দরবনের অপূর্ব বন্ত সৌন্দর্য এই এক মাসের প্রতিদিন আমার ক্ষুধার্ত ব্যগ্র বালক-মনে কি আনন্দের বার্তা বয়ে আনতো তা আমি মুখে আপনাদের বোঝাতে পারি না। আর কখনও সে-দেশে যাইনি, অনেকদিনের কথা হলেও এখনো মাঝে মাঝে মুন্দরবনের—বিশেষ করে জ্যোৎস্না-ওঠা সুন্দরবনের ছবি ...অপরিসর খালের শঠির জঙ্গলে ভরা ঢালু পাড় । নতুন পাতা-ওঠা গাব-গাছের ও বস্ত গোল-গাছের সারি...থাডির মুখে জোয়ারের শব্দ, যখনই মনে হয়, একটা জিনিসের জন্তে বেদনায় এই বয়সেও মনটা কেমন করে ওঠে। সেদিনের কথাটা আমার বেশ মনে আছে। মুন্দরবনের সেই অংশটা তখন জরীপ হচ্ছিল—তাদের একটা বড় লঞ্চ বড়-গাঙের মাঝখানে বাধা থাকতো । দুপুরবেলা সেদিন সেই লঞ্চটাতে আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল। চার পাঁচজন আমীন, একজন কানুনগে, একজন কেরানী—সবাই বাঙালী, সবসুদ্ধ সাত আটজন লোক লঞ্চটাতে। খাওয়া-দাওয়াটা খুব গুরুতর রকমের হোল, তারপর একটু গান-বাজনাও হোল। বেলা পড়ে গেলে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে আমাদের বজরাট ছাডলাম । ক্রমে রাত হোল, জ্যোৎস্না উঠলো। খালের দু’ধারের নতুন পাতা-ওঠা বনের মাথাটা জ্যোৎস্নায় চিকচিক্‌ করছিল দূর থেকে নৈশ পাখীর দু'একটা অদ্ভুত রকমের ডাক কানে আসছিল জোয়ারের জলে মগ্ন গোল-গাছের আনত শাখাগুলো ভাটার পরে একটু একটু করে জল থেকে জেগে উঠতে লাগলো। বাঘের উপদ্রবের ভয়ে সব সময় আমাদের বজরাতে দু'জন বন্দুকধারী সিপাহী থাকতে, তার বজরার ও-ধারের তোল-উমুনে রান্না চাপিয়ে দিলে। রাতটা বড় গরম, গুমোট ধরনের। গাছের পাতাটি পর্যন্ত নড়ছিল না, চারিদিকে একটা নীরব থমথমে ভাব । ছই-এর ভেতরে থাকবার উপায় নেই। বজরার ছাতে তক্তার পাটাঙনের ওপর এসব গ্রীষ্মের রাতে শুয়ে থাকতে খুব আরাম বটে, কিন্তু অপরিসর খালের দু’ধারের ঘন বন থেকে বাঘ লাফিয়ে পড়বার ভয়ে সেখানে থাকবার যো ছিল না। ছই-এর মধ্যে বসে কাকা ও বিনোদবাবু দাবা খেলছিলেন। ছই-এর ঘুলঘুলিগুলো সব খোল, আমি নিকটে বসে বই পড়ছি। খেলতে খেলতে রাত হয়ে গেল দশটার বেশী । সিপাহীদের রান্না হয়ে গেল । কাকা কি-একটা কঠিন চাল সামলাবার কথা একমনে ভাবছেন—আমি মিটমিটে আলোতে আখ্যান-মঞ্জরী পড়ছি—বিনোদবাৰু খেলোয়াড়কে সমস্তায় ফেলবার আত্মপ্রসাদে ভাকিয়া ঠেস দিয়ে ঘুলঘুলির বাইরে ভাটার টান ধরা জলের দিকে চেয়ে আছেন। দীর্ঘ বন-গাছের ছায়া পড়েছে জলের ওপর।