পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মৌরীফুল 36 বেয়ে ভীষণভর হিম-বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে মাতালের মত টলতে টলতে পথ চলছেন.তার মাথা যেন ক্রমে মুরে বুকের ওপর এসে পড়েছে.কিন্তু তবু তিনি না থেমে ক্রমাগত পথ চলছেন বহুদূরের এক উত্তঙ্গ তুষারমণ্ডিত পর্বতচূড়া কিসের আলোয় রক্তাভ হয়ে দৈত্যের হাতের মশালের মত সে বিশাল তুহিন রাজ্যের দূর প্রান্ত আলোকিত করে ধ্বক ধ্বক্ করে জলছে । -- তুষার-বাষ্প ঘন হতে ঘনশ্বর হয়ে সমস্ত দৃগুটা ঢেকে ফেললো। তারপরই চোখের সামনে –এ যে আমারই চিরপরিচিত বাংলা দেশের পাড়াগী..খড়ের ঘরের পেছনে ছায়ণগহন বাশবনে বিকাল নেমে আসছে । বৈঁচি-ঝোপে শালিক পার্থীর দল কিচ কিচ করচে । কাটালতলায় কোন গৃহস্থের গরু বাধা ! মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে এক তরুণ যুবক । তার সামনে আমার খুঁড়ে-বার-করা সেই দেবীমূর্তি “দেখে মনে হোল, যুবকের অনেক দিনের স্বপ্ন ঐ পাথরের মূর্তিতে সফল হয়েছে:বর্ষাসন্ধ্যার মেঘ-মেদুর আকাশের নিচে ঘনপ্তাম কেতকী-পল্লবের মত কালো ভাবগভীর চোখদুটি মেলে সে পাথরের মূর্তির মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে।-- হঠাৎ সে দৃশ্যও মিলিয়ে গেল। দেখি, আমি আমার ঘরে থাটেই শুয়ে আছি, পাশে সেই বৌদ্ধ-ভিক্ষু এবার তিনি কথা বললেন । তার কথাগুলো আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে । তিনি বললেন—তুমি যে মূর্তিটি মাটি খুঁড়ে বার করেছ, তারই টানে অনেক দিন পরে আজ আবার পৃথিবীতে ফিরে এলাম। নয় শ বৎসর আগে আমি তোমার মতই পৃথিবীর মানুষ ছিলাম। যে স্থান তোমরা খুঁড়েছ, ওই আমার বাস্তুভিটা ছিল । তুমি জ্ঞানচর্চায় সমস্ত জীবন যাপন করেছ, এই জন্তেই তোমার কাছে আসা আমার সম্ভব হয়েছে ; এবং এই জন্তেই আমি অত্যস্ত আনন্দের সঙ্গে আমার জীবনের কতকগুলি প্রধান প্রধান ঘটনা তোমাকে দেখালাম। আমি দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান,—নয়পালদেবের সময়ে আমি নালন্দা মহাবিষ্কারের সঙ্ঘস্থবির ছিলাম। ভগবান তথ্যগতের অমৃতময়ী বাণীতে আমার মন মুগ্ধ হয়েছিল; সে জন্ম দেশের হিন্দুসমাজে আমার জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়। দেশের টোলের অধ্যাপনা ছেড়ে আমি নালন্দ যাই। বুদ্ধের নির্মল ধর্ম যখন তিব্বতে অনাচারগ্রন্ত হয়ে উঠেছিল, তখন ভগবান শাক্যত্রীর পরে আমি তিব্বত যাই সে ধর্ম পুনরুদ্ধারের জন্তে । আমার সময়কার এক গৌরবময় দিনের কথা আজও আমার স্মরণ হয়। আজ অনেকদিন পরে পৃথিবীতে—বাংলায় ফিরে এসে সে-কথা বেশী করে মনে পড়েছে। 'চেদীরাজ কর্ণ দিগ্বিজয়ে বার হয়ে দেশ জর করতে করতে গৌড়-মগধ-বঙ্গের রাজা নয়পালদেবের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে যে-দিন সন্ধি করলেন, আমি তখন নালনায় অধ্যাপক। মনে আছে, উৎসাহে সে-দিন সারারাত্রি আমার নিদ্রা হয়নি। এই সন্ধির কিছুদিন পরেই কর্ণের কন্যা যৌবনীর সঙ্গে নয়পালদেবের পুত্র তৃতীয় বিগ্রহপালের যে বিবাহ হয়, আমিই সে বিবাহের পুরোহিত ছিলাম। অল্প বয়সে আমি একজন গ্রাম্য শিল্পীর কাছে পাথরের মূর্তি গড়তে শিথি এবং অবসর মত আমি তার চর্চা রাখতাম। তারপর আমি যখন পিতামহের টোলে সারস্বত ব্যাকরণের ছাত্র, তখন সমস্ত শক্তি ও কল্পনা ব্যয় করে