পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○>や বিভূতি-রচনাবলী প্রেসিডেন্সি কলেজেই অধ্যাপক নিযুক্ত হন। রাজচন্দ্রবাবু তার পূর্ব থেকেই সেখানে অধ্যাপক। আমি তখন ছাত্র। মোটে ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছি পাড়াগায়ের স্কুল থেকে এসে। ইডেন হিন্দুহোস্টেলে থাকি। ভয়ে ভয়ে কলকাতার পথে বেড়াই, কি জানি কখন গাড়ি-ঘোড়া চাপা পড়ি, কি পথই হারিয়ে বসি । এত চায়ের দোকান তখন ছিল না, কলেজে স্কোয়ার অঞ্চলে দু'তিনটেই যা ছিল। জাত যাবার ভয়ে ভার ত্রিসীমানায় কখনও পাদিতাম না । এ-সবের দরুণ অঞ্জ-পাড়াগেয়ে বলে একটা অখ্যাতিও রটে ছিল আমার নামে । সেদিন শনিবার। বেশ মনে আছে কি একটা ছুটি উপলক্ষে আমি বাড়ি যাবে। শোনা গেল পদার্থ-বিদ্যার লেকচার-থিয়েটারে রাজচন্দ্রবাবু একটা প্রবন্ধ পড়বেন। উৎসাহে পড়ে হোস্টেলের আরও দশ জনের সঙ্গে আমিও গিয়ে গ্যালারীতে ভিড় বাধিরে তুললাম। খুব গোলমাল হচ্ছিল। হঠাৎ প্রবন্ধ-পাঠক বক্তৃতা মঞ্চে উঠতেই গোলমাল থেমে সব চুপ হয়ে গেল । প্রকাও মাথা ও একমুখ আধিকালো, আধপাক খাটো ঘন দাড়ি, বেঁটে চেহারা, মাথাটা দেহের অনুপাতে অত্যন্ত বড়। শ্মশ্রযুক্ত বামনের মত চেহারাখানা। চোখ দুটোর দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, চকুচকে ইস্পাতের মত একটা অস্বাচ্ছন্দ্যকর দীপ্তি। ফাস্ট ইয়ার শ্রেণীর ছাত্র, উচ্চাঙ্গের গণিত বিষয়ক কোন প্রবন্ধ বোঝাবার কোনো ক্ষমতা না থাকলেও, গ্যালারীতে ছাত্রের ভিড়, কলেজের বহু অধ্যাপকের উপস্থিতি, প্রবন্ধের ভেতরকার অপরিচিত বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞাগুলি ও সেগুলির উচ্চারণধ্বনি, সকলের ওপর বক্তার চেহারা—সব মিলিয়ে আমার বড় ভাল লাগলো। তারপর আরও বক্তৃত। তার শুনেছি, যত বুঝি আর না-বুঝি প্রত্যেক বারই আমার অস্তুত: মনে হোত যে এমন একটা মনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে, যা পথে-ঘাটে সুলভ নয় । যে-ধরনের লোক পৃথিবীটার ওজন মাপে, বড় গির্জা গড়ায়, সেীর-জগতের বয়স ঠিক করে জোয়ারের সঙ্গে সময়ের সম্বন্ধ খাড়া করে, পৃথিবীর রেডিয়ম-ভাণ্ডার ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়—রাজচন্দ্রবাবুকে সেই শ্রেণীর মানুষ বলে মনে হোত। নলিনাক্ষবাবু বা রাজচন্দ্রবাবু কেউই আমাদের ক্লাসে পড়াতেন না। কলেজের তেতলার বারানীয় কতদিন বক্তৃতী-ঘণ্টার ফাকে দেখতাম রাজচন্দ্রবাবু অন্তমনস্ক হয়ে হেঁটে চলেছেন—এ অবস্থার অনেক সময় তিনি নিজের পড়ানোর ক্লাসটিতে যেতে ভুলে গিয়ে হঠাৎ অন্ত এক অধ্যাপনারত অধ্যাপককে বিপন্ন করে তার ক্লাসটিতে ঢুকে পড়তেন এবং পরক্ষণেই চমক ভেঙে অস্ফুটম্বরে কি বলেই সে ঘর থেকে বার হয়ে পড়তেন। ছেলেরা বলাবলি করতে, তিনি সব সময় গণিতের উচু বিষয় চিপ্ত করেন, পৃথিবীর মাটির খবর রাখেন না। তা না রাখুন তাতে ক্ষতি ছিল না, কিন্তু রাজচন্দ্রবাবু উপরওয়ালার মেজাজের খবরটাও বড় একটা রাখতেন না বা রাখার জন্তে গ্রাহ ও করতেন না । এটাই ছিল তার মহৎ দোষ । প্রিন্সিপাল লসন সাহেবের নাম প্রেসিডেন্সি কলেজের সে সময়ের ছাত্রদের কাছে আর দুবার বাবার দরকার হবে না-খুব ভাল লোক, দর্শন ট্রাইপলে জয়পতাকা উড়িয়ে পাস ! সুতরাং