পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অভিযাত্রিক J86. একটা খুব বড় বাড়ি দেখে তার সামনে দাঁড়ালুম। এক সময়ে খুব ভালো অবস্থার গৃহস্থের বাড়ি ছিল এটা, নইলে আর এত বড় বাড়ি তৈরি করতে পারেনি। এখন ধারা থাকে, তাদের অবস্থা যে খুব ভালো নয়, এটা ওদের দোতলার বারানাতে পুরোনো চাচের বেড়া দেখে আন্দাজ করা কঠিন হয় না। করোগেট টিন জোটেনি তাই বাশের চাচ দিয়েচে । একজনকে জিগ্যেস করলুম—এটা কাদের বাড়ি বাপু ? —বাবুদের বাড়ি। এ গায়ের জমিদার ছেলেন ওঁয়ার — —এখন কেউ নেই ? —থাকবেন না কেন বাবু, কলকাতায় থাকেন। বাবুদের ছোট সরিকেরা এখন থাকেন এ বাড়িতে। তেনাদের অবস্থা ভালো নয়। বাবুরা সব উকিল, মোক্তাগার, অনেক পয়সা রোজগার করেন, এখানে আর আসেন না । অথচ যখন মুন্দরপুরের বাইরে এলুম, তখন মুসলমান ও কাঙালী পাড়ার অবস্থা দেখে চোখ জুড়লো। ওরা প্রায়ই বাস করে ফাক মাঠে, বাডির কাছে বনজঙ্গল কম, খড়ের বাড়ি হলেও বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ধানের গোলা দুতিনটি অনেকের বাড়িতেই চোখে পড়ে, তরিতরকারির বাগান করে রেখেচে বাড়ির পাশেই, দুপাঁচটা গোরু সকলেরই আছে। এদের স্বাস্থ্য খুব খারাপ নয়—যারা থেটে খায় এমন লোকের মধ্যে ম্যালেরিয়া হতে বেশি বেথিনি—ডায়েবিটিস, ডিসপেপসিয়া, ব্লাডপ্রেসারের নামগন্ধ নেই সেখানে । ওরা যখন মরে, তখন বেশির ভাগ মরে কলেরাতে । শীতের শেষে বাংলার পাড়াগায়ে চাষাপাড়া মরে দূলধাবাড় হয়ে যেতে দেখেচি কলেরাতে—অথচ ভদ্রলোকের পাড়ায় এ রোগ খুব কম ঢুকতে দেখেচি। তবে আজকাল গ্রামে গ্রামে নলকূপ বসবার ফলে ম্যালেরিয়া যতটা না কমুক, কলেরার মড়ক অনেক কমেচে। নলকূপের জল বারোমাস ব্যবহার করে, অথচ বারোমাস ম্যালেরিয়ায় ভুগে জীৰ্ণ শীর্ণ, এমন লোক বা পরিবার অনেক দেখেচি। কিন্তু আমি যা বলতে যাচ্ছিলুম— পায়ে হেঁটে বাংলার অনেক গ্রামেই ঘুরেচি, সর্বত্রই দেখেচি, সমান অবস্থা—ভদ্রলোকের পতন, মুসলমান ও অমুন্নত জাতির অভু্যদয়। ভদ্রলোকের পাড়ায় ভগ্ন অট্টালিকা, মজাপুকুর, ভগ্ন দেবালয়, ঘন বনজঙ্গল—আর চাষাপাড়ায় ক্ষেতভরা তরিতরকারি, গোয়ালভরা গোরু, ধামের মরাই, ছাগল, ভেড়া, ইস ইত্যাদি গৃহপালিত পশুপক্ষীর পাল। হলফ নিয়ে অবিপ্তি বলতে পারব না যে সব চাষারই এই অবস্থা—তবে অনেকেরই বটে। ভদ্রলোকদের মধ্যে সাধারণত ধারা শিক্ষিত ও উপার্জনক্ষম, তারা থাকে বিদেশে শহরে, আর ঝড়তি-পড়তি মাল যেগুলি, তারা নিরুপার অবস্থায় পড়ে থাকে গ্রামে, শিক্ষিত ও প্রবাসী জ্ঞাতিদের পরিত্যক্ত বাড়ি-ঘুরে । এরা বেলা বারোটা পর্যন্ত কোনো গাছতলায় কি কারো বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে বসে তামাক টানে আর বাজে গল্প ও পরচর্চা করে, সন্ধ্যাবেল বসে তাস খেলে, কিংবা শখের যাত্রার দলে