পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অভিযাত্রিক ৩৬৩ মাঝি মাত্র একজন, চাটগায়ের বুলিতে বললে, কতদূর যাবেন বাৰু ? —অনেকদূর চলো সমূত্রের মধ্যে। সন্ধের পর ফিরবেী— —আদিনাথ যাবেন ? একটা ছোট পাহাড় সমুদ্রগর্ভ থেকে খাড়া উঠেছে—তার মাথায় আদিনাথ শিবের মন্দির। এ অঞ্চলের এটি একটি প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান, অনেক দূর থেকে লোকে আসে আদিনাথ দৰ্শন করতে, শিবরাত্রির সময় বড় মেলা হয়। কাউখালি নদী যেখানে এসে সমূদ্রে পড়লো, ভার ডাইনে প্রায় মাইল দুই দূরে আদিনাথ পাহাড় সমুদ্র থেকে উঠেচে, আর ঠিক সামনে অদূরেই একটা বড় চড়ার মতো কি দেখা যাচ্চে। মাঝিকে বললুম—ওটা কি চড়া পড়েচে ? মাঝি বললে—না বাবু, ওটা সোনাদিয়া দ্বীপ। ভাটার পরে ওখানে অনেক কড়ি, শাক, ঝিনুক পড়ে থাকে। শুনে আমার লোভ হল। মাঝিকে সোনাদিয়া দ্বীপে যেতে বললুম। মাঝি একবার কি একটা আপত্তি করলে, আমি ভালো বুঝলুম না ওর কথা। সাম্পান সাগর বেয়ে চলেচে, বিকেল পাচটা, সমুদ্রের বুকে স্বর্য ডুবুডুবু, ছ-ই খোলা হাওয়া কাউথালির মোহান দিয়ে ভেসে আসচে, আদিনাখ পাহাড়ের মাথায় অস্ত-সুর্যের রাঙা রোদ। মনে হয় যেন কত কাল ধরে সমুদ্রের বুকে ভাসচি, দূরের সাউথ সি দ্বীপপুঞ্জের অধচন্দ্রীকৃতি সাগরবেলা, যা ছবিতে ছাড়া কথনে দেখিনি—তাও যেন অনেক নিকটে এসে পৌছেচে—তাদের খাম নারিকেলপুঞ্জের শাখাপ্রশাখার সঙ্গীত যেন শুনতে পাই। সোনাদিয়া দ্বীপে যখন সাম্পান ভিড়লো তখন জ্যোৎস্না উঠেচে। ছোট্ট চড়ার মতো ব্যাপারট, গঙ্গার বুকে বালি হুগলি শহরের সামনে অমন ধরনের চড়া কত দেখেচি ছেলেবেলায়। একটা গাছপালা নেই, বাড়িঘর তো নেই-ই, শুধু একটা বালির চড়া—জল থেকে তার উচ্চতা কোথাও হাত থানেকের বেশি নয়। কিন্তু সে কি মুন্দর জায়গা ! অতটুকু বালির চড়া বেষ্টন করে চারি ধারে অকুল জলরাশি, জ্যোৎস্নালোকে দূরের তটরেখা মিলিয়ে গিয়েচে। আদিনাথ পাহাড়ও আর দেখা যায় না, সুতরাং আমার অনুভূতির কাছে প্রশান্ত মহাসমুদ্রের বুকে যে-কোনো জনহীন দ্বীপই বা কি, আর কক্সবাজারের সমুদ্র-উপকূল থেকে মাত্র দু মাইল দূরের সোনাদিয়া দ্বীপই বা কি, আমাদের গ্রামের মাঠে বসে বৈকালে আকাশের দিকে চেয়ে মেঘস্তুপের মায়ায় রচিত তুষারমৌলী হিমালয়ের গৌরীশঙ্কর শৃঙ্গ কি ত্রিশূল কতদিন প্রত্যক্ষ করিনি কি ! মনে কল্পনায় এই জগৎকে আমরা অহরহ স্বষ্টি করে চলেচি—আমরা নিজেরাই স্থার স্ৰষ্টা। প্রত্যেক মাস্থ্যটি স্রষ্টা ; যার যেমন কল্পনা, যার যেমন ধারণাশক্তি, যেমন স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার ভাগুর—সে তেমনি স্বষ্টি করে। বই লেখা, উপন্যাস-লেখাই শুধু স্বষ্টি নয়। প্রতিদিনের ধ্যান ও স্বপ্ন আমাদের চারপাশে মারাজালের যে বুন্থনি রচনা করে তাও স্বষ্টি। তারই বাহ প্রকাশ হয় সঙ্গীতে, কথাশিল্পে, ছবিতে, নাটকে, কথাবার্তার মধ্যে, স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে । কোন মাস্থ্য স্ৰষ্ট নয় ?