পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৪২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

888 বিভূতি-রচনাবলী পরিচয়। এ সব ক্ষেত্রে যেমন হয়, উকিলবাবু যখন কথা বলচেন, সেখানে আর কেউ বলতে না কিছু, তিনিই একমাত্র বক্তা। যেমন, আমাকে কখনো তিনি কিছু বলবার অবকাশ দেননি। আমার ইচ্ছে করলেও বলতে পারতাম না। আমার মনে হত ভদ্রলোক খুব ভালো কিন্তু বড় সংকীর্ণ জগতে নিজেকে আবদ্ধ রেখেচেন । ওঁর জগৎ এই নিজের বাডিটি নিয়ে, এই আশ্রিতজনদের নিয়ে, এদের মধ্যে রাজত্ব করেই র্তার প্রতিষ্ঠা। এদের বাইরে অন্ত কোনো জগৎ ইনি দেখেচেন কি ? কথনও দেখবার তৃষায় ব্যাকুল হয়েচেন কি ? না দেখলেও কোনো ক্ষতি নেই, যদি অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষীর আবুলত মনের মধ্যে সদ্যজাগ্রও থাকে। বাসনা ও ব্যাকুলত৷ মনের যৌবন। ও দুটে চলে গিয়েচে যে মন থেকে সে মনে জর বাসা বেঁধেচে । নিজে তো মুখ পায় না, অপরকেও দিতে পারে না। সব বাসনার অবসান যে মনে, আকুলতা তীব্রত যে মন থেকে—তৃপ্তিব দ্বারা ভোগের দ্বারাই হোক, বা ক্ষীয়মাণ কল্পনার জন্তেই হোক-চলে গিয়েচে, সে মন স্থবির। যেখানে গিয়েচি, সেখানেই দেখেচি উৰ্ণনাভ যেমন নিজের জালের মধ্যে জডিয়ে বসে থাকে, গুটিপোকা যেমন গুটির মধ্যে নিজেকে বন্দী রাখে, প্রত্যেকে এক এক নিজস্ব ক্ষুদ্র জগতে নিজেদের বন্দী রেখে হৃষ্টমনে জীবনের পথে চলেচে, এজন্মে তারা অমুখী নয, অতৃপ্ত নয়। কত জগৎ দেখে বেড়ালে তবে সংকীর্ণতার জ্ঞান মানসপটে প্রতিভাত হয়। এই জ্ঞানটাই বড়, এই জ্ঞান অর্জন করা সময়সাপেক্ষ তাও জানি ; মমুম্বাত্বকে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করবার পথে প্রধান সহায় প্রসারতাকে চেনা, তাহলেই সংকীর্ণতাকেও চেনা যায । নোয়াখালি থেকে আমি গেলুম মেঘনার তীরবর্তী একটি ক্ষুদ্র গ্রামে। সেখানে কোনো কাজের জন্তে যাইনি, বিস্তৃত মেঘনা নদীর তীরে বসে একটা দিন অলসভাবে কাটাতে গিযেছিলুম। বিদায় নিষেই এসেচি নোয়াখালি থেকে, এখানে দুদিন কাটিয়ে অন্ত দিকে চলে যাবো । আমার কাজ ছিল মেঘনার ধারে একটি ক্ষুদ্র ঝোপের ছায়ায় চুপ করে সারাদিন বসে থাকা। বড় গাছ সেখানটাতে নেই, নদীর ধারে বর্ষার ভাঙনে সব গিয়েচে, আছে এখানেওখানে দু-একটা ছোটখাটো ঝোপ । ভারি অননে কাটিয়েছিলাম এখানে এই ছটি দিন। এত বড় নদী আমাদের দেশে নেই, মেঘনার বিরাট বিস্তৃতিকে সমুদ্র বলে মনে হত, যেন কক্সবাজারের সমুদ্রতীরে বসে আছি, আমার সামনে যেন চিরজীবন অবসর, কত্ত স্বপ্ৰজাল বোনবার অবকাশ, দীর্ঘ, দীর্ঘ অবকাশ । সব চেয়ে ভালো লাগতে বিকেলে । ধীরে ধীরে ছায়া পড়ে আসতো বড় বড় ধাঁনের মাঠের উপর, মেঘনার বিস্তৃত জলরাশির উপর। জলচর পাখীর বিরাট দল আকাশ অন্ধকার করে যেন কোন মুদূর কালের চরের দিকে উড়ে ৰেতো—সন্ধ্যারাগরক্ত আকাশের আভা পড়ও জলে, দূরের বৃক্ষশ্রেণীর মাথায় ; তারপরে