পাতা:বিভূতি রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

6. নেই। পথ অতিক্রম করেই সে পথের খবর জানে। জীবন-পথ কখনও দাগম, কখনও সুগম ৷ পথপাব কখনও প্রতিকুল, কখনও অন্যকুল । পথিকবন্ধ কখনও সহজন কখনও দুজন। পথের দেবতা মানব-ভাগ্যবিধাতা ; তাঁর ইঙ্গিতে মানুষ পথ চলে। এই রুপকটি পথের পাঁচালী”-র লেখকের মনে ছিল, এবং সেই অনুসারে তিনি বই-এর নামকরণও করেছিলেন। পথের পাঁচালী’-তে যে-পথের শীর সেই একই পথ পথের পাঁচালী পেরিয়ে 'অপরাজিত'-তে এসে পড়েছে । ‘অপরাজিত'-তে পথের চেহারার পরিবতনু হয়েছে, পরাতন পথিক বিদায় নিয়েছে, নতন পথিক এসেছে । কিন্তু পথ এগিয়ে চলেছে, এবং পথ অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে পরে প্রধান পথিক অপ । ‘পথের পাঁচালী এবং অপরাজিত অপর জীবন-পথ অতিক্রমণের কাহিনী । সুতরাং বই দুখানি হলেও, একখানি আর একখানির পরিপরেক । একখানিকে বাদ দিলে সমগ্র পথের খবর পাওয়া যায় না, অনেক পথিককে চেনা শক্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং ব্যবহারিক প্রয়োজনে পথের পাঁচালী”-র পালা-ভাগ করা হয়েছে। ‘পথের পাঁচালী’ প্রথম পালা, "অপরাজিত" দ্বিতীয় পালা । দ্বিতীয় পালা অপরাজিত’-তে অপ-জীবনের উত্তর খণ্ড । এ-জীবনের শরে জীবনপথের আর একটি বাঁকে । রায়চৌধুরী বাড়ী থেকে নিৰ্ম্মকৃমণ এবং মনসাপোতায় পদাপণ— অপর জীবন-পথের এই বাঁকটিতে পাঁচালীর প্রথম পালার সমাপ্তি এবং দ্বিতীয় পালার শর। লেখকের মতে কাহিনীর এই বিন্দুটিই পথের সবচেয়ে বড় বর্কি । ‘পথের পাঁচালী’র শেষে ‘জানার গণ্ডী এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে’ যাত্রাকালে পথের দেবতা অপর ললাটে ‘আনন্দ যাত্রার অদশ্য তিলক' পরিয়ে দিয়েছেন । পালা-ভাগের যথাথfতায় সংশয় জাগে । ভবতারণ চক্লবতীর আমন্ত্রণে মনসাপোতায় যাত্রা অপ-জীবনের একটি বড় ঘটনা বলে মনে করতে পারি না । একথা ঠিক, মনসাপোতায় সবজিয়ার মৃত্যু এবং সেখানেই অপর দাপত্য-জীবনের শর। কিন্তু মনসাপোতায় অপর সহায়ীভাবে বেশি দিন বাস করে নি । মনসাপোতায় যাজনবত্তিতে অপর—বিশেষ করে সবজিয়ার—জীবন-সমস্যার যে একটি সহজ সমাধানের সভাবনা দেখা দিয়েছিল অপর তাকে সমাধান বলে স্বীকার করতে পারে নি। এমন কি শেষ পযন্ত মনসাপোতা ছেড়ে নিশ্চিন্দিপরে গিয়ে বাস করার কথাও দু-একবার সবজিয়ার মনে উকি দিয়েছে। মনসাপোতার মানুষ-প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে অপস-সবজিয়ার সংযোগ ক্ষীণ, নেই বললেও চলে। সেখান থেকে অপর জীবনের কোনো নতন সম্পদ আহরণ করে নি। জীবন-যাত্রাপথে মনসাপোতা একটি সাময়িক আশ্রয়, যেমন সাময়িক আশ্রয় ছিল চৌধুরীবাড়ী ( সাময়িক আশ্রয় হলেও চৌধুরীবাড়ীর জীবন নানা কারণে মুল্যবান ; একটি কারণ, লীলাকে এই বাড়ী থেকেই পাওয়া গিয়েছিল ) । একটি সাময়িক আশ্রয় থেকে আর একটি সাময়িক আশ্রয়ে যাওয়ার ঘটনাকে জীবন-পথের একটি বড় বকি বলতে পারি না । মনসাপোতাআড়বোয়ালের মাইনর কুল—দেওয়ানপরের মডেল ইনস্টিটিউশান অর্থাৎ রায়চৌধুরী বাড়ী ত্যাগ এবং কলকাতায় আগমন অপর জীবন-পথের এই বাঁকটি ক্ষুদ্র, দরিত্বেও বটে, গরত্বেও বটে। অথচ এই ক্ষুদ্র গুরত্বহীন বাঁকটি অতিক্রমণের প্রাক্কালে পথের দেবতা মহাসমারোহে অপর কপালে তিলক একে দিয়েছেন এবং লেখকও এইখানেই তাঁর প্রথম পালা সমাপ্ত করেছেন । প্রথম পালার যথার্থ সমাপ্তি নিশ্চিন্দিপুরেরকাহিনীর সমাপ্তিতে। অরুর সংবাদ দ্বিতীয় পালার বস্তু , নিশ্চিন্দ্রিপরের পরিচিত পরিবেশ-পরিজনের স্নেহচ্ছায়ার বাইরে অপরিচিত বহত্তর জগতে প্রথম পদক্ষেপই অপর জীবনের বহত্তম পদক্ষেপ । এর পরে পথের দেবতার ইঙ্গিতে সে এক অপরিচিত জগৎ থেকে আর এক অপরিচিত জগতে পদক্ষেপ করেছে।