পাতা:বিভূতি রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ყo বিভূতি-রচনাবলী অপরাহের বাতাস ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিয়াছে। বক্রতোয়া হইতে খানিকটা দরে ঘন বনের মধ্যে পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট ঝরণা, যেন উচু চৌবাচ্চা ছাপাইয়া জল পড়িতেছে এমন মনে হয় । নিচের একটা খাতে গ্রীমদিনেও জল থাকে। রাত্রে ওখানে হরিণদের দল জল খাইতে আসে শনিয়া অপর কতবার দেড় প্রহর রাত্রে ঘোড়ায় চড়িয়া সেখানে গিয়াছে, কখনও দেখে নাই । গ্রীম গেল, বষণও কাটিল, শরৎকালে বন্য শেফালিবনে অজস্র ফুল ফুটিল, বক্রতোয়ারশাল-ঝাড়টার কাছে বসিলে তখনও ঝরণার শব্দ পাওয়া যায়—এমন সময়ের এক জোৎস্নারাত্রে সে জহরী সিংকে সঙ্গে লইয়া জায়গাটাতে গেল । দশমীর জ্যোৎসনা ডালে-পাতায়, পাহাড়ী বাদাম বনের মাথায়—স্নিগ্ধ বাতাসে শেফালির ঘন মিন্ট গন্ধ । এই জ্যোৎস্নামাখা বনভুমি, এই রাত্রির স্তৰধতা, এই শিশিরাদু’ নৈশ বায় - এরা যেন কত কালের কথা মনে করাইয়া দেয়, যেন দরে কোনও জন্মাস্তরের কথা । হরিণের দল কিন্তু দেখা গেল না । এই সব নিউজ’ন স্থানে অপ দেখিল মনের ভাব সপিণ অন্যরকম হয় । শহরে বা লোকালয়ে যে-মন আত্মসমস I লহয়া ব্যাপতে থাকে, ambition লইয়া ব্যস্ত থাকে, এখানকার উদার নক্ষত্রখচিত আকাশের তলায় সে-সব আশা, আকাংক্ষা, সমস্য অতি তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। মন. আরও ব্যাপক হয়, উদার হয়, দুটা হয়, angle of vision একদম বদলাইয়া যায় । এই জন্য অনেক অনেক বই-ই - গাহস্থ্যি সমাজে যা খুব ঘোরতর সমস্যামলক ও প্রয়োজনীয় ও উপাদেয় -এখানকার নিঃসঙ্গ ও বিশ্বতোমখেী জীবনে তা অতি খেলো, রসহীন ও অপ্রয়োজনীয় মনে হয় । এখানে ভাল লাগে সেই সব, যাহা শাশ্বত কালের । এই অনন্তের সঙ্গে যাহার যোগ আছে । অপর সেই গ্রহবিজ্ঞানের বইখানা যেমন— এখন যেন তাদের নতুন অথ" হয় । এত ভাবিতে শেখায় ! চৈতন্যের কোন নতুন দ্বার যেন খলিয়া যায়। ফালগন মাসে একজন ফরেস্ট সাভেয়ার আসিয়া মাইল দশেক দরে বনের মধ্যে তীবন ফেলিলেন । অপু তাঁহার সহিত ভাব করিয়া ফেলিল। মাদ্রাজী ভদ্রলোক, বেশ লেখাপড়া জানা । অপর প্রায়ই সন্ধ্যাটা সেখানে কাটাইত, চা খাইত, গল্পগুজব করিত, ভদ্রলোক থিওডোলাইট পাতিয়া এ-নক্ষত্র ও-নক্ষত্র চিনাইয়া দিতেন, এক একদিন আবার দাপরে নিমন্ত্ৰণ করিয়া একরকম ভাতের পিঠা খাওয়াইতেন, অপর সকালে উঠিয়া যাইত, দপরের পর খাওয়া সারিয়া ঘোড়ায় নিজের তাঁবুতে ফিরিত । 龜 ফিরিবার পথে ডানদিকের পাহাড়ী ঢালতে বহদের ব্যাপিয়া শীতের শেষে লোহিয়া ও বিজনির ফুলের বন । ঘোড়া থামাইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিত, তাঁবুতে ফিরিবার কথা ভুলিয়া যাইত। যে কখনও এমন নিজন আরণ্যভূমিতে—যেখানে ক্লোশের পর ক্লোশ যাও লোক নাই, জল নাই, গ্রাম নাই, বস্তি নাই –সে-সব স্থানের মুক্ত আকাশের তলে কঠিন ব্যালাস্ট কি গ্রানাইটের রক্ষ পৰ্বত-প্রাচীরের ছায়ায়, নিম্নভূমিতে, ঢালতে ঝাঁ-ঝাঁ দাপরে রাশি রাশি অগণিত বেগনি জরদা ও বেতাভ হলুদ রঙের বন্য লোহিয়া ও বিজনির ফুলের বন না দেখিয়ছে—তাহাকে এ দশ্যের ধারণা করানো অসম্ভব হইবে । এমন কত শত বৎসর ধরিয়া প্রতি বসন্তে রাশি-রাশি ফুল ফুটিয়া ঝরিতেছে, কেহ দেখিবার নাই, শতধনু ভোমরা ও মৌমাছিদের মহোৎসব । একদিন অমর-কণ্টক দেখিতে যাইবার জন্য অপর মিঃ রায়চৌধুরীর নিকট ছুটি চাহিল । মনটা ইহার আগে অত্যন্ত উতলা হইয়াছিল, কেন যে উতলা হইল, কারণটা কিছতেই ভাল ধরিতে পারিল না । ভাবিল এই সময় একবার ঘুরিয়া আসিবে।