পাতা:বিভূতি রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৩৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যালাবদল Oq6. থাকা দরকার,—গলপটা ঠিক বুঝতে হোলে, সেটা আমাকে গোড়াতেই বলে দিতে হবে । হিমাংশ যখন আমার সঙ্গে থাকতো, তখন তার চালচলন দেখলে মনে হবাব কথা যে, সে বেশ অবস্হাপন্ন ঘরের ছেলে । সে যে আহার-বিহারে বা বেশভূষায় খুব বেশী শোঁখীন ছিল তা নয়, তার শখ ছিল নানা ধরনের এবং এই শখের পেছনে সে পয়সা ব্যয় করতো নিতান্ত বে-আন্দাজী । তার প্রধান শখ ছিল গাছপালা ও ফুলের । আমার ফুলের শখটা হিমাংশর কাছ থেকেই পাওয়া একথা বলতে আমার কোনো লজ্জা নেই । কারণ যত তুচ্ছ, যত অকিঞ্চিৎকর জিনিস হয়েই হোক না কেন, যেখানে সত্যি কোনো আগ্রহ বা ভালবাসার সম্প্রধান পাওয়া যায়—তাকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। হিমাংশর গাছপালার ওপর ভালবাসা ছিল সত্যিকার জিনিস। সে ভালো খেতো না, ভাল কাপড় জামা কখনো দেখি নি তার গায়ে—কিন্তু এ ধরনের সখে-স্বাচ্ছন্দ্য তার কাম্যও ছিল না । তার পয়সার সচ্ছলতা ছিল না কখনো, টুইশনি করে দিন চালাতো, তাও আবার সব সময় জুটতো না, তখন বন্ধ বান্ধবদের কাছে ধার করতো। যখন ধারও মিলতো না তখন দিনকতক চন্দননগরে এক মাসীর বাড়ি গিয়ে মাস-খানেক, মাস-দই কাটিয়ে আসতো। কিন্তু পয়সা হাতে হলে কাপড় জামা না কিনকে, খাওয়া-দাওয়ায় ব্যয় করকে না করকে, ভালো গাছপালা দেখলে কিনবেই ৷ 象 মেসে আমাদের ঘরের সামনে ছোট একটা অপরিসর বারান্দাতে সে তার গাছপালার টবগুলো রাখতো। গোলাপের ওপর তার তত ঝোঁক ছিল না, সে ভালবাসতো নানা জাতীয় পামা-বিশেষ করে বড় জাতীয় পাম –আর ভালবাসতো দেশী-বিদেশী লতা—উইগটারিয়া, অতসী, মাধবীলতা, বোগেনভিলিয়া ইত্যাদি । কত পয়সাই যে এদের পিছনে খরচ করেছে । সকালে উঠে ওর কাজই ছিল গাছের পাট কত্তে' বসা । শুকনো ডালপালা ভেঙ্গে দিচ্ছে, গাছ ছেটে দিচ্ছে, এ টবের মাটি ও টবে ঢালচে । পরোনো টব ফেলে দিয়ে নতুন টবে গাছ বসাচ্চে, মাটি বদলাচ্চে ! আবার মাঝে মাঝে মাটির সঙ্গে নানা রকমের সার মিশিয়ে পরীক্ষা কত্ত । এ সব সম্বন্ধে ইংরেজি বাংলা নানা বই কিনতো—একবার কি একটা উপায়ে ও একই লতায় নীলকলমী ও সাদাকলমী ফোটালে । ভায়োলেটের ছিট ছিট দেওয়া অতসী অনেক কটে তৈরী করেছিল । বেগনী রং-এর ক্লাইসেনথিমামের জন্যে অনেক পরিশ্রম ও অথ ব্যয় করেছিল, সবিধে হয় নি। তাছাড়া ও ধরনের মানুষ আমি খুব বেশী দেখি নি, যে একটা খেয়াল বা শখের পেছনে সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে দিতে পারে। মানুষের মনের শক্তির সে একটা বড় পরিচয় । হিমাংশ বলতো—সেদিন একটা পাড়াগাঁয়ে একজনদের বাড়ি গিয়েচি বুঝলেন?--তাদের গোলার কাছে তিন বছরের পরোনো নারকেল গাছ হয়ে আছে । সে যে কি সন্দের দেখাচ্চে ! একটা প্রকাণ্ড তাজা, সতেজ, সবুজ পাম । সমুদ্রের ধারে নাকি নারকেলের বন আছে—পাম-এর সৌন্দয্য দেখতে হোলে সেখানে যেতে হয়। হিমাংশ প্রায়ই পাম আর অকিড দেখতে শিবপর বোটানিক্যাল গাডেনে যেতো। আর এসে তাদের উচ্ছসিত বণনা করতো । একবার সে একটা এরিকা পাম কিনে আনলে । খুব ছোট নয়, মাঝারি গোছের মাটির টবে বসানো—কিন্তু এমন সন্দের, এমন সতেজ গাছ বাজারে সাধারণতঃ দেখা যায় না। সে সন্ধান করে করে দমদমায় কোন বাগানের মালীকে ঘষে দিয়ে সেখান থেকে কেনে । কলকাতার মেসের বারাদায় গাছ বাঁচিয়ে রাখা যে কত শক্ত কাজ, যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবেন। গোবি মরভূমিতে গাছ বাঁচিয়ে রাখা এর চেয়ে সহজ ।