পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

‘. ধীরানন্দ বাহিরে গেলেন। সত্যানন্দ ও মহেন্দ্র * কারাগারমধ্যে বাস করিতে লাগিলেন । 空; --- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ ব্ৰহ্মচারীর গান অনেকে শুনিয়াছিল । অন্যান্ত লোকের মধ্যে জীবানন্দের কানে সে গান গেল । মহেন্দ্রের অনুবত্তী হইবার তাহার প্রতি আদেশ ছিল, ইহা পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে। পথিমধ্যে একটি স্ত্রীলোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইয়াছিল । সে সাত দিন খায় নাই, রাস্তার ধারে পণ্ডিয়া ছিল। তাহার জীবনদান জন্য জীবানন্দ দণ্ড দুই বিলম্ব করিয়াছিলেন । মাগীকে বাচাইয়। তাহাকে অতি কদৰ্য্য ভাষায় গালি দিতে দিতে ( বিলম্বের অপরাধ তার ) এখন আসিতেছিলেন । দেখিলেন, প্রভুকে মুসলমানে ধরিয়া লইয়। যাইতেছে—প্ৰভু গান গায়িতে গায়িতে চলিয়াছেন । জীবানন্দ মহাপ্রভু সত্যানন্দের সঙ্কেত সকল বুঝিতেন । “ধীরসমারে তটিনীতীরে বসতি বনে বরনারী” নদীর ধারে আবার কোন মাগী ন খেয়ে পড়িয়া আছে না কি ? ভাবিয়। চিন্তিয়, জীবানন্দ নদীর ধুীরে ধারে চলিলেন । জীবানন্দ দেখিয়াছিলেন যে, ব্রহ্মচারী স্বয়ং মুসলনান কর্তৃক নীত হইতেছেন । এ স্থলে ব্রহ্মচারীর উদ্ধারই ত{হার প্রথম কাজ । কিন্তু জীবানন্দ ভাবিলেন, “এ সঙ্কেতের সে অর্থ নয়। তার জীবনরক্ষার অপেক্ষা ও তাহার তা জ্ঞাপালন বড় —এই তাহার কাছে প্রথম শিথিয়াছি । অতএব তাহার আজ্ঞাপালনই করিব।” – নদীর ধারে ধারে জীবানন্দ চলিলেন । যাইতে স্নাইতে সেই বৃক্ষতলে নদীতীরে দেখিলেন যে, এক স্ত্রীলোকের মৃতদেহ, আর এক জীবিত শিশু-কন্ত । পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে, মহেন্দ্রের স্ত্রী-কন্যাকে জীবানন্দ একবারও দেখেন নাই। মনে করিলেন, ‘হইলে হইতে পারে যে, ইহারাই মহেন্দ্রের স্ত্রীকন্যা । কেন না, প্রভুর সঙ্গে মহেন্দ্রকে দেখিলাম । যাহা হউক, মাতা মৃত, কন্যাটি জীবিত। আগে ইহার রক্ষাবিধান করা চাই—নইলে বাঘ-ভালুকে খাইবে । ভবানন্দ ঠাকুর এইখানেই কোথায় আছেন, তিনি স্ত্রীলোকটির সৎকার করিবেন। এই ভাবিয়া জীবানন্দ বালিকাকে কোলে তুলিয়া লইয়া চলিলেন। মেয়ে কোলে তুলিয়া জীবানন্দ গোসাই সেই নিবিড় জঙ্গলের অভ্যস্তরে প্রবেশ করিলেন। জঙ্গল বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী পার হইয়া একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে প্রবেশ করিলেন । গ্রামখানির নাম ভৈরবীপুর । লোকে বলিত, ভরুইপুর । ভরুইপুরে কতকগুলি সামান্ত লোকের বাস, নিকটে আর বড় গ্রাম নাই, গ্রাম পার হইয়াই আবার জঙ্গল । চারিদিকে জঙ্গল—জঙ্গলের মধ্যে একখানি ক্ষুদ্র গ্রাম ; কিন্তু গ্রামখানি বড় সুন্দর । কোমল তৃণাবৃত গোচারণভূমি ; কোমল শু্যামল পল্লবযুক্ত আম, কাটাল, জাম, তালের বাগান ; মাঝে নীলজল পরিপূর্ণ স্বচ্ছ দীঘিকা । তাহাতে । জলে বক, হংস, ডাহুক ; তীরে কোকিল, চক্রবাক ; কিছু দুরে ময়ুর উচ্চরবে কেকাধবনি করিতেছে। গৃহে গৃহে, প্রাঙ্গণে গাভী, গৃহের মধ্যে মরাই, কিন্তু আজকাল দুর্ভিক্ষে ধান নাই—কাহারও চালে একটি ময়নার পিজরা, কাহারও দেয়ালে আলিপনা— কাহারও উঠানে শাকের ভূমি । সকলেই দুর্ভিক্ষে পীড়িত, কৃশ, শীর্ণ, সস্তাপিত । তথাপি এই গ্রামের লোকের একটু ঐছাদ আছে–জঙ্গলে অনেক রকম মনুষ্যখাদ্য জন্মে, এ জন্য জঙ্গল হইতে খাদ্য আহরণ করিয়! সেই গ্রামবাসীর। প্রাণ ও স্বাস্তা রক্ষা করিতে পারিয়াছিল । একটি বৃহং আম্রকাননমধ্যে একটি ছোট বাড়ী, চারিদিকে মাটার প্রাচীর, চারিদিকে চারিখানি ঘর । গৃহস্থের গোরু আছে, ছাগল আছে, একটা ময়ূর আছে, একট ময়ন আছে, একটা টীয় অাছে । একটা বাদর ছিল, কিন্তু সেটাকে আর খাইতে দিতে পারে ন। বলিয়। ছাড়িয়া দিয়াছে । একটা টেকি আছে, বাহিরে খামার আছে, উঠানে লঘুগাছ আছে, গোটাকতক মল্লিক। দুইয়ের গাছ আছে । কিন্ত এবার তাতে ফুল নাই । সব ঘরের দাওয়ায় একটা একটা চরকা আছে ; কিন্তু বাড়াতে বড় লোক নাই । জীবানন্দ মেয়ে কোলে করিয়! সেই বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করি লেন । বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিয়াই জীবানন্দ একটা ঘরের দাওয়ায় উঠিয়া চরক। লইয়া ঘেনর বেনর আরম্ভ করিলেন । সে ছোট মেয়েটি কখন চরকার শব্দ শুনে নাই । বিশেষতঃ মা-ছাড়া হইয়া অবধি কাদিতেছে, চরকার শব্দ শুনিয়া ভয় পাইয়া আরও উচ্চ সপ্তমে উঠিয়া কাদিতে আরম্ভ করিল। তখন ঘরের ভিতর হইতে একটি সতের কি আঠার বৎসরের মেয়ে বাহির হইল । মেয়েট বাহির হুইয়া দক্ষিণ-গণ্ডে দক্ষিণহস্তের অঙ্গুলি সন্নিবিষ্ট করিয়া ঘাড় বাকাইয়া দাড়াইল । বলিল, “এ কি এ ? দাদা চরকা কাটো কেন ? মেয়ে কোথায় পেলে ? দাদা,