পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কপালকুণ্ডল৷ গেল । তাহারা উদাসীনের শ্রবণাতিক্রান্ত হইলে রমণী মুত্স্বরে কি কথ। কহিল। নবকুমারের ফর্ণে এই শব্দ প্রবেশ করিল, “কোথা যাইতেছ? যাইও না'। ফিরিয়া যাও —পলায়ন কর।” এই কথ। সমাপ্ত করিয়াই উক্তিকারিণী সরিয়৷ গেলেন, প্রত্যুত্তর শুনিবার জন্য তিষ্ঠিলেন না। নব কুমার কিন্তুতকাল অভিভূতের স্তায় দাড়াইলেন, পশ্চা দ্বর্তী হইতে ব্যগ্র হইলেন, কিন্তু রমণী কোন দিকে গেল, তাহার কিছুই স্থিরতা পাইলেন না । মনে করিতে লাগিলেন—“এ কাহার মায়া ? না আমারই ভ্ৰম হইতেছে ? ষে কথা শুনিলাম-—সে ত আশঙ্কাস্থচক কিন্তু কিসের আশঙ্ক ? তান্ত্রিকেরা সকলই করিতে পালে । তবে কি পলাইব ? কোথায় পলাইবার স্থান আছে ?” নবকুমার এইরূপ চিন্তা করিতেছিলেন, এমন সময় দেখিলেন, কাপালিক তাহাকে সঙ্গে না দেখিন্ধ প্রএ)বৰ্ত্তন করিতেছে । কপলিক কহিল, “বিলম্ব করি তেছ কেন ?" যখন লোকে ইতিকৰ্ত্তব্য স্থির করিতে ন৷ তখন তাহাদিগকে যে দিকে প্রথম আহ্বত করা যায়, সেই দিকেই প্রবৃত্ত হয় । কাপালিক পুনরহান ক তে বিনবিকবারে নলকুমার তাহর পশ্চাদ্বন্ত্রী হইলেন । কিয়দর গমন করিয়া সম্মুখে এক মৃতপ্রাচীর বিশিষ্ট কুটায় দেখিতে পাইলেন । তাহাকে কুটারও বণ যাইতে পারে, ক্ষুদ্র গৃহও বলা যাইতে পারে । কিন্তু ইহাতে আমাদিগের কোন প্রয়োজন নাই । ইহার পশ্চাতেই সিকতাময় সমুদ্রতীর । গৃহপাশ্ব দিয়৷ কাপালিক নবকুমারকে সেই সৈকতে লইয়া চলিলেন ; এমন সময় তারের তুল্য বেগে পূৰ্ব্বদৃষ্ট রমণী তাহার পাশ্ব দিয়া চলিয়। গেল। গমনকালে তাহার কর্ণে বলিয়া গেল, “এখনও পলাও । নরমাংস নহিলে তান্ত্রিকের পূজা হয় না, তুমি কি জান না ?" নবকুমারের কপালে স্বেদনিৰ্গম হইতে লাগিল । তুর্ভাগ্যবশতঃ সূৰ্বতীর এই কথা কপালিকের কণে গেল। সে কহিল, "কপালকুণ্ডলে !" .স্বর নবকুমারের কর্ণে মেঘগর্জনবৎ ধ্বনিত হুইল । কিন্তু কপালকুণ্ডলা কোন উত্তর দিল না । কাপালিক নবকুমারের হস্ত ধারণ করিয়া লইয়৷ যাইতে লাগিল। মানুষঘাতী করম্পর্শে নবকুমারের শোণিত ধমনীমধ্যে শতগুণ বেগে প্রধাবিত হইল— লুপ্ত সাহস পুনৰ্ব্বার আসিল । কহিলেন, “হস্ত ত্যাগ করুন ।” পারে. X > কাপালিক উত্তর করিল না । নবকুমার পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমায় কোথায় লইয়! যাইতেছেন ?” * কাপালিক কহিল, “পূজার স্থানে " নবকুমার কহিলেন, “কেন ?" কাপালিক কহিল, “বধর্থ।” অতিতালবেগে নবকুমার নিজ হস্ত টানিলেন। যে বলে তিনি হস্ত আকৰ্ষিত করিয়াছিলেন, তাহাতে সামান্য লোকে তাহার হাত পরিয়া থাকিলে, হস্তরক্ষা কর। দূরে থাকুক,-বেগে ভূপতিত হইত। কিন্তু কাপালিকের অঙ্গমাত্রও হেলিল না ;-নবকুমারের প্রকোষ্ঠ তাহার হস্তমধ্যেই রহিল । নবকুমারের অস্থিগস্থিসকল যেন ভগ্ন হষ্টয়া গেল ! মুমূর্যর ন্যায় নবকুমার কাপালিকের সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন । সৈকতের মধ্যস্তানে নীত হইয়া নবকুমার দেখিলেন, পূৰ্ব্বদিনের তার তথায় বৃহৎ কাষ্ঠে অগ্নি জলিতেছে। চতুষ্পাশ্ব ভাবিকপূজার আয়োজন রহিয়াছে। ভম্মপ্যে নরকপালপূর্ণ আসব রহিয়াছে—কিন্তু শব নাই । অনুমান করিলেন, তাহাকেই শব হইতে হইবে । কতকগুলি শুদ্ধ, কঠিন লতাগুল্ম তথার পূর্ব হইতে আহরিত ছিল । কাপালিক তদ্বারা নবকুমারকে দৃঢ় বন্ধন করিতে আরম্ভ করিল । নবকুমার সাধা মত বলপ্রকাশ করিলেন ; কিন্তু বলপ্রকাশ কিছুমাত্র ফলদায়ক হইল না ! তাহার প্রতীতি হইল যে, এ বয়সে ও কাপালিক মত্তহস্তীর বল ধারণ করে । নবকুমাবের বলপ্রকাশ দেখিয়া কাপালিক কহিল, “মূৰ্খ! কি জঙ্গ বলপ্রকাশ কর ? তোমার জন্ম আজি সার্থক হইল । ভৈরবীর পূজার তোমার এই মাংসপিণ্ড আর্পিত হুইবে । ইহার অধিক তোমার তুলা লোকের আর কি সৌভাগ্য হইতে পারে ? কাপালিক নবকুমারকে দৃঢ় বন্ধন করিয়া সৈক তোপরি ফেলিয়। রাখিলেম এবং বধের প্রাক্কালিক পূজাদি ক্রিয়ায় ব্যাপৃত হইলেন । ততক্ষণ নবকুমার বঁধেন ছিড়িবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন ; কিন্তু শুষ্ক লতা অতি কঠিন-বন্ধন অতি দৃঢ় । মৃত্যু আসন্ন ! নবকুমার ইষ্টদেবচরণে চিত্ত নিবিষ্ট করিলেন। একবার জন্মভূমি মনে পড়িল, নিজ মুখের আলর মনে পড়িল, একবার বহুদিন অস্তৰ্হিত জনক এবং জননীর মুখ মনে পড়িল, দুই এক বিন্দু অশ্রজল সৈকত-বালু কায় শুধিয়া গেল । কাপালিক বলির প্রাক্কালিক ক্রিয়া সমাপনাস্তে বধার্থ খড়গ লইবার জন্য আসন ত্যাগ