পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৪ তাহার বস্ত্রীও ধরিয়া কহিলেন, “ভাল, সে যাউক । বিধাতার যদি সেই ইচ্ছ, তবে চিত্তবৃত্তি সকল অতল জলে ডুবাইব । আর কিছু চাই না, এক একবার তুমি এই পথে যাইও, দাসী ভাবিয়া এক একবার দেখা দিও, কেবল চক্ষু: পরিতৃপ্তি করিব।” নব । তুমি যবনী—পরস্ত্রী—তোমার সহিত এরূপ আলাপেও দোষ । তোমার সহিত আর আমার সাক্ষাৎ হইবে না । ক্ষণেক নীরব । লুৎফউন্নিসার হৃদয়ে ঝটিক৷ বহিতেছিল। প্রস্তরময়ী মূৰ্ত্তিবৎ নিম্পন্দ রছিলেন। নবকুমারের বস্ত্রাগ্রভাগ ত্যাগ করিলেন । কহিলেন, “যাও ” নবকুমার চলিলেন । দুই চারি পদ চলিয়াছিলেন মাত্র, সহসা লুতফউন্নিস বাতোস্মৃলিত পাদপের ন্যায় তাহার পদতলে পড়িলেন । বাহুলতায় চরণযুগল বদ্ধ করিয়া কাতরস্বরে কহিলেন, “নির্দয় ! আমি তোমার জন্য আগ্রার সিংহাসন ত্যাগ করিয়া আসিয়াছি, তুমি আমায় ত্যাগ করিও ন| T নবকুমার কহিলেন, “তুমি আবার আগ্রাতে ফিরিয়া যাও, আমার আশা ত্যাগ কর " এ জন্মে নহে। লুৎফউন্নিসা তীরবৎ দাড়াইয়া উঠিয় সদৰ্পে কহিলেন, “এ জন্মে তোমার আশ| ছাড়িব না।” মস্তক উন্নত করিয়া, ঈষৎ বঙ্কিম গ্রীবাভঙ্গী করিয়া, নবকুমারের মুখ-প্রতি অনিমেষ আয়ত চক্ষুঃ স্থাপিত করিয়া, রাজরাজমোহিনী দাড়াইলেন । যে অনবনমনীয় গৰ্ব্ব হৃদয়াগ্নিতে গলিয়া গিয়াছিল, আবার তাহার জ্যোতিঃ স্ফুরিল ; যে অজেয় মানসিক শক্তি ভারত রাজ্যশাসনকল্পনায় ভীত হয় নাই, সেই শক্তি আবার প্রণয়দুৰ্ব্বলদেহে সঞ্চারিত হইল । ললাটদেশে ধমনী সকল স্ফীত হইয়া রমণীয় রেখা দিল ; জ্যোতিৰ্ম্ময় চক্ষুঃ রবিকরমুখরিত সমুদ্রবারিবৎ ঝলসিতে লাগিল ; নাসারন্ধ কঁাপিতে লাগিল । স্রোতোবিহারিণী রাজহংসী যেমন গতিবিরোধীর প্রতি গ্রীবাভঙ্গী করিয়া দাড়ায়, দলিতফণ। ফণিনী যেমন ফণা তুলিয়া দাড়ায়, তেমনি উন্মাদিনী যবনী মস্তক তুলিয়া দাড়াইলেন । কহিলেন, “এ জন্মে না, তুমি আমারই হইবে ।” সেই কুপিতফণিনীমূৰ্ত্তিপ্রতি নিরীক্ষণ করিতে করিতে নবকুমার ভীত হইলেন। লুৎফউন্নিসার অনিৰ্ব্বচনীয় দেহমহিম। এখন ষেরূপ দেখিতে পাইলেন, সেরূপ আর কখনও দেখেন নাই। কিন্তু সে ঐ বজ্রস্থচক বিদ্যুতের ন্যায় মনোমোহিনী, দেখিয়া ভয় হইল। নবকুমার চলিয়া যান, তখন সহসা বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী তাহার আর এক তেজোময়ী মূৰ্ত্তি মনে পড়িল । এক দিন নবকুমার তাহার প্রথমা পত্নী পদ্মাবতীর প্রতি বিরক্ত হইয়। র্তাহাকে শয়নাগার হইতে বহিষ্কৃত করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন । দ্বাদশবর্ষীয়া বালিকা তখন সদৰ্পে ৰ্তাহার দিকে ফিরিয়া দাড়াইয়াছিল, এমনই তাহার চক্ষুঃ প্রদীপ্ত হইয়াছিল ; এমনই ললাটে রেখাবিকাশ হইয়াছিল ; এমনই নাসারন্ধ কঁাপিয়াছিল ; এমনই মস্তক হেলিয়াছিল। বহুকাল সে মূৰ্ত্তি মনে পড়ে নাই, এখন মনে পড়িল । অমনই সাদৃশ্ব অনুভূত হইল। সংশয়াধীন হইয়া নবকুমার সঙ্কুচিত স্বরে ধীরে ধীরে কহিলেন, “তুমি কে ?” যবনীর নয়নতারা আরও বিস্ফারিত হইল কহিলেন, “আমি পদ্মাবতী |" উত্তর প্রতীক্ষা না করিয়া লুৎফউল্লিস স্থানান্তরে চলিয়। গেলেন। নবকুমারও অন্যমনে কিছু শঙ্কান্বিত হইয়া, আপন অলিয়ে গেলেন । সপ্তম পরিচ্ছেদ উপনগর প্রান্তে I am settled, and bend up Each corporal agent to this terrible scat. —Macbeth. কক্ষান্তরে গিয় লুৎফউন্নিসা দ্বার রুদ্ধ করিলেন । দুই দিন পর্য্যস্ত সেই কক্ষ হইতে নির্গত হইলেন না । এই দুই দিনে তিনি নিজ কৰ্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্য স্থির করিলেন । স্থির করিয়া দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইলেন । স্বৰ্য্য অস্তাচলগামী । তখন লুৎফউন্নিসা পেষ মনের সাহায্যে বেশভূষা করিতেছিলেন । আশ্চৰ্য্য বেশভূষা । পেষওয়াজ নাই—পায়জামা নাই— । ওড়না নাই ; রমণীবেশের কিছুমাত্র চিহ্ন নাই। যে বেশভূষা করিলেন, তাহ মুকুরে দেখিয়া পেয মনকে কহিলেন, “কেমন পেয মন, আর আমাকে চেনা যায় ?” পেয মন কহিল, “কার সাধ্য ?” লু। তবে আমি চলিলাম । কোন দাস-দাসী না যায় । পেষ মন কিছু সঙ্কুচিতচিত্তে কহিল, “যদি দ্বাসীর অপরাধ ক্ষমা করেন, তবে একটি কথা জিজ্ঞাসা করি।” লুৎফউন্নিসা কছিলেন, “কি ?” অামার সঙ্গে যেন