পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কপালকুণ্ডল আসিতেছি। কেন আমি দেবতুষ্টির জন্য শরীর না দিলাম ? এক্ষণে তাহার ফলভোগ করিলাম । যে আমাকে রক্ষা করিয়াছিল, সেই আমাকে নষ্ট করিল। কাপালিক ? আমাকে এবার অবিশ্বাস করিও না । আমি এখনই আসিয়া তোমাকে আত্মসমর্পণ করিব ।” কাপালিক কহিল, “আমি তোমার প্রাণবধার্থ আসি নাই । ভবানীর তাহা ইচ্ছ। নহে । আমি যাহা করিতে আসিয়াছি, তাহা তোমার অনুমোদিত হইবে । বাটীর ভিতরে চল, আমি যাহা বলি, তাহা শ্রবণ কর।” নবকুমার কহিলেন, "এক্ষণে নহে । সময়াস্তরে তাহা শ্রবণ করিব, তুমি এখন অপেক্ষ কর, আমার বিশেষ প্রয়োজন আছে, সাধন করিয়৷ আসিতেছি ।” কাপালিক কহিল, “বৎস ! আমি সকলই অরগত আছি, তুমি সেই পাপিষ্ঠার অনুসরণ করিবে । সে যথায় ষাইবে, আমি তাহ অবগত অাছি ; আমি তোমাকে সে স্থানে সমভিব্যাহারে করিয়া লইয়৷ যাইব । যাহা দেখিতে চাহ দেখাইব - এক্ষণে আমার কথা শ্রবণ কর । কোন ভয় করিও না।” নবকুমার কহিলেন, “আর তোমাকে আমার কোন ভয় নাই । আইস ” এই বলিয়া নবকুমার কাপালিককে গৃহাভ্যন্তরে লইয়া গিয়া আসন দিলেন এবং স্বয়ং উপবেশন করিয়া বলিলেন, “বল ।” ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ পুনরালাপে “তদুগচ্ছ সিদ্ধৈ কুরু দেবকাৰ্য্যম্ " –কুমারসম্ভব । কাপালিক আসন গ্ৰহণ করিয়া দুই বাহু নবকুমারকে দেখাইলেন । নবকুমার দেখিলেন, উভয় বাহু ভগ্ন । পাঠক মহাশয়ের স্মরণ থাকিতে পারে যে, যে রাত্রে কপালকুণ্ডলার সহিত নবকুমার সমুদ্রতার হইতে পলায়ন করেন, সেই রাত্রে তাহাদিগের অন্বেষণ করিতে করিতে কাপালিক বালিয়াড়ির শিখরচু্যত হইয়া পড়িয়া যান। পতনকালে দুই হস্তে ভূমি ধারণ করিয়া শরীর রক্ষা করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহাতে শরীর রক্ষা হুইল বটে, কিন্তু দুইটি হস্ত ভাঙ্গিয়া গেল। কাপালিক এ সকল বৃত্তান্ত নবকুমারের নিকট বিবরিত করিয়া কহিলেন, “বাহু দ্বারা ૪૭” নিত্যক্রিয়। সকল নিৰ্ব্বাহের কোন বিশেষ বিঘ্ন হয় ন। কিন্তু ইহাতে আর কিছুমাত্র বল নাই। এমন কি, ইহার দ্বারা কৃষ্ঠাহরণে কষ্ট হয় ।" পরে কহিতে লাগিলেন, “ভূপতিত হইয়াই আমি | জানিতে পারিয়াছিলাম যে, আমার করদ্বয় ভগ্ন হইয়াছে, আর আর অঙ্গ অভয় আছে, এমত নহে, আমি পতনমাত্র মূচ্ছিত হইয়াছিলাম। প্রথমে অবিচ্ছেদে অজ্ঞানবস্থায় ছিলাম। পরে ক্ষণে সজ্ঞান, ক্ষণে অজ্ঞান রহিলাম কয় দিন যে আমি এ অবস্থায় রহিলাম, তাহ বলিতে পারি না । বোধ হয়, দুই রাত্রি এক দিন হুইবে । প্রভাতকালে আমার সংজ্ঞ। সম্পূর্ণরূপে পুনরাবিভূত হইল। তাহার অব্যবহিত পূৰ্ব্বেই আমি এক স্বপ্ন দেখিতেছিলাম । যেন ভবানী—” বলিতে বলিতে কাপালিকের শরীর রোমাঞ্চিত হইল । “যেন ভবানী আসিয়া আমার প্রত্যক্ষীভূত হইয়াছেন । ভ্ৰকুটা করিয়া আমায় তাড়ন করিতেছেন ; কহিতেছেন, ‘রে দুরাচার । তোরই চিত্তাশুদ্ধি হেতু আমার পূজার এ বিঘ্ন জন্মাইয়াছে। তুই এ পর্য্যস্ত ইন্দ্রিয়লালসায় বদ্ধ হইয়৷ , এই কুমারীর শোণিতে এত দিন আমার পূজা করিস নাই ; অতএব এই কুমারী হইতেই তোর পূর্বকৃত্যু ফল বিনষ্ট হইল। আমি তোর নিকট আর কখন পুজা গ্রহণ করিব না । তখন আমি রোদন করিয়া জননীর চরণে অবলুষ্ঠিত হইলে তিনি প্রসন্ন হইয়। কহিলেন, “ভদ্র । ইহার একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত বিধান করিব। সেই কপালকুণ্ডলাকে আমার নিকট বলি দিবে। যত দিন না পার, আমার পূজা করিও ন। " “কত দিনে ব৷ কি প্রকারে আমি আরোগ্য প্রাপ্ত হইলাম, তাহা আমার বর্ণন করিবার প্রয়োজন নাই । কালে আরোগ পাইয়। দেবীর আজ্ঞা পালন করিবার চেষ্টা আরম্ভ করিলাম । দেখিলাম যে, এই বাহুদ্বয়ে শিশুর বলও নাই । বাহুবল ব্যতীত যত্ন সফল হুইবার নহে । অতএব ইহাতে এক জন সহচারী আবখ্যক হইল । কিন্তু মনুষ্যবৰ্গ ধৰ্ম্মে অল্পমতি—বিশেষ কলির প্রাবল্যে যবন রাজী, পাপাত্মক রাজশাসনের ভয়ে কেহই এমত কার্য্যে সহচর হয় না । বহু সন্ধানে আমি পাপীয়সার আবাসস্থান জানিতে পারিয়াছি। কিন্তু বাহুবলের অভাব হেতু ভবানীর আজ্ঞাপালন করিতে পারি নাই। কেবল মানসসিদ্ধির জন্ত তন্ত্রের বিধানানুসারে ক্রিয়াকলাপ করিয়া থাকি মাত্র । কল্য রাত্রে নিকটস্থ বনে হোম করিতেছিলাম, স্বচক্ষে দেখিলাম, কপালকুণ্ডলার সহিত এক ব্রাহ্মণকুমারের মিলন