পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8૭ . . . বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী লঘুম্বরে কথোপকথনের প্রয়োজনে উভয়ে এরূপ সন্নিকটবর্তী হইয়া বসিয়াছিলেন যে, লুৎফউন্নিসার পৃষ্ঠ পৰ্য্যস্ত কপালকুণ্ডলার কেশের সম্প্রসারণ হইয়াছিল । তাহা তাহারা দেখিতে পান নাই । দেখিয়া নবকুমার ধীরে ধীরে ভূতলে বসিয়া পড়িলেন । কাপালিক ইহা দেখিয়া নিজ কাটবিলম্বী এক নারিকেলপাত্র বিমুক্ত করিয়া কহিল, “বৎস! বল হারাইতেছ, এই মহৌষধ পান কর, ইহা ভবানীর প্রসাদ । পান করিয়া বল পাইবে ।” কাপালিক নবকুমারের মুখের নিকট পাত্র ধরিল । তিনি আন্তমনে পান করিয়া দারুণ তুষা নিবারণ করিলেন । নবকুমার জানিতেন না যে,এই মুম্বাদ পেয় কাপালিকের স্বহস্ত প্রস্তুত প্রচণ্ড তেজস্বিনী স্বরা । পান করিবামাত্র সবল হইলেন । এ দিকে লুৎফউন্নিসা পূৰ্ব্ববৎ মৃত্যুস্বরে কপালকুণ্ডলাকে কহিতে লাগিলেন, “ভগিনি ! তুমি যে কার্য্য করিলে, তাহার প্রতিশোধ করিবার আমার ক্ষমতা নাই ; তবু যদি আমি চিরদিন তোমার মনে থাকি, সে-ও আমার মুখ । যে অলঙ্কারগুলি দিয়াছিলাম, তাহা শুনিয়াছি, তুমি দরিদ্রকে বিতরণ করিয়াছ। এক্ষণে নিকটে কিছুই নাই । কলাকার অন্য প্রয়োজন ভাবিয়া কেশমধ্যে একটি অঙ্গুরায় আনিয়াছিলাম, জগদীশ্বরের কৃপায় সে পাপ প্রয়োজনসিদ্ধির আবখ্যক হইল না। এই অঙ্গুরীয়টি তুমি রাখ। ইহার পরে অঙ্গুরীয় দেখিয়া যবনী ভগিনীকে মনে করিও । আজি ধদি স্বামী জিজ্ঞাসা করেন, 'অঙ্গুরীয় কোথায়ু পাইলে ?’ কহিও লুৎফ উল্লিস দিয়াছে’ ” ইহা কহিয়া লুৎফউন্নিসা আপন অঙ্গুলী হইতে বহুধনে ক্রীত এক অঙ্গুরীয় উন্মোচন করিয়া কপালকুণ্ডলার হস্তে দিলেন । নবকুমার তাহাও দেখিতে পাইলেন । কাপালিক তাহাকে ধরিয়াছিলেন, আবার তাহকে কম্পমান দেখিয়া পুনরপি মদির সেবন করাইলেন । মদির নবকুমারের মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়া তাহার প্রকৃতি ংহার করিতে লাগিল, স্নেহের অঙ্কুর পর্য্যস্ত উন্মুলিত করিতে লাগিল । কপালকুণ্ডলা লুৎফউন্নিসার নিকট বিদায় হইয়৷ গৃহাভিমুখে চলিলেন । তখন নবকুমার ও কাপালিক লুৎফউন্নিসার অদৃশু-পথে কপালকুণ্ডলার অনুসরণ করিতে লাগিলেন । অষ্টম পরিচ্ছেদ গৃহাভিমুখে “No spectre greets me—no vain bಲ್ಡ್ರ' this.” -Wordsworth. কপালকুণ্ডলা ধীরে ধীরে গৃহাভিমুখে চলিলেন । অতি ধীরে ধীরে অতি মৃদু মৃদু চলিলেন । তাহার কারণ, তিনি অতি গভীর চিন্তামগ্ন হুইয়। যাইতেছিলেন । লুৎফউন্নিসার সংবাদে কপালকুণ্ডলার একেবারে চিত্তভাব পরিবৰ্ত্তিত হইল ; তিনি আত্মবিসর্জনে প্রস্তুত হইলেন । আত্মবিসর্জন কি জন্য ? লুৎফউন্নিসার জন্ত ? তাহা নহে । কপালকুণ্ডল অন্তঃকরণ সম্বন্ধে তান্ত্রিকের সন্তান ; তান্ত্রিক যেরূপ কালিকাপ্রসাদাকাঙ্ক্ষায় পরপ্রাণংহারে সঙ্কোচশুষ্ঠ, কপালকুণ্ডলাও সেই আকাজক্ষায় আত্মজীবন বিসর্জনে তদ্রুপ । কপালকুণ্ডল যে কাপালিকের দ্যায় অনন্তচিত্ত হইয়া শক্তিপ্রসাদপ্রার্থিণী হইয়াছিলেন, তাহা নহে; তথাপি অহনিশ শক্তিভক্তি শ্রবণ, দর্শন ও সাধনে তাহার মনে কালিকানুরাগ বিশিষ্ট প্রকারে জন্মিয়াছিল । ভৈরবী যে স্বষ্টিশাসনকত্রী মুক্তিদাত্রী, ইহা বিশেযমতে প্রতীত হইয়াছিল । কালিকার পূজাভূমি যে নরশোণিতে প্লাবিত হয়, ইহা তাহার পরওঃখজুঃখিত হৃদয়ে সহিত না, কিন্তু আর কোন কার্য্যে ভক্তিপ্রদর্শনের ক্রটি ছিল ন। । এখন সেই জগৎশাসনকত্রী, সুখদুঃখবিধায়িনী, কৈবল্যদায়িনী ভৈরবী, স্বপ্নে তাহার জীবনসমর্পণ আদেশ করিয়াছেন। কেনই ব৷ কপালকুণ্ডল সে আদেশ পালন না করিবেন ? তুমি আমি প্রাণত্যাগ করিতে চাহি ন । রাগ করিয়া যাহা বলি, এ সংসার সুখময় । সুখের প্রত্যাশাতেই বৰ্ত্তলবৎ সংসারমধ্যে ঘুরিতেছি—দুঃখের প্রত্যাশায় নহে । কদাচিৎ যদি আত্মকৰ্ম্মদোষে সেই প্রতাশা সফলীকৃত না হয়, তবেই দুঃখ বলিয়া উচ্চ কলরব আরম্ভ করি । তাহা হইলেই দুঃখ নিয়ম নহে, সিদ্ধান্ত হইল : নিয়মের ব্যতিক্রম মাত্র । তোমার আমার সর্বত্র সুখ । সেই মুখে আমরা সংসারমধ্যে বদ্ধমূল; ছাড়িতে চাহি না । কিন্তু এসংসারবন্ধনে প্রণয় প্রধান রজু। কপালকুণ্ডলার সে বন্ধন ছিল না—কোন বন্ধনই ছিল না । তবে কপালকুণ্ডলাকে কে রাখে ? যাহার বন্ধন নাই, তাহারই অপ্রতিহত বেগ । গিরিশিখর হইতে নিঝরিণী নামিলে, কে তাহার গতিরোধ করে? একবার বায়ু তাড়িত হইলে কে তাহার সঞ্চারণ নিবারণ করে ? কপালকুণ্ডলার চিত্ত