পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/২০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দেবী চৌধুরাণী ফৌজদারী তাছারই জিন্ম । তিনি.দলে দলে সিপাহী ডাকাত ধরিতে পাঠাইতে লাগিলেন । সিপাহীরা কিছুই করিতে পারিল না । অতএব ভুলভৈর ভয়, তিনি ডাকাতি করিয়া প্রফুল্লকে লইয়া যাইতেছেন, আবার তার উপর ডাকাতে না ডাকাতি করে । পান্ধী দেখিয়া ডাকাতের আসা সম্ভব । সেই ভয়ে বেহারার নিঃশব্দ । গোলমাল হইবে বলিয়া সঙ্গে আর অপর লোকজনও নাই, কেবল দুলভ নিজে আর ফুলমণি । এইরূপে তাহার। ভয়ে ভয়ে চারি ক্রোশ ছাড়াইল । তার পর বড় ভারি জঙ্গল আরম্ভ হইল । বেহারারা সভয়ে দেখিল, দুই জন মানুষ সম্মুখে আসিতেছে । রাত্রিকাল, কেবল নক্ষত্রালোকে পথ দেখা যাইতেছে । সুতরাং তাহাদের অবয়ব অস্পষ্ট দেখা যাইতেছিল । বেহারারা দেখিল, যেন কালাস্তক যমের মত দুই মূৰ্ত্তি আসিতেছে। এক জন বেহার। অপরদিগকে বলিল, “মানুষ দুটোকে সন্দেহ হয় ।” অপর আর এক জন বলিল, “রাত্রে যখন বেড়াচে, তখন কি আর ভালমানুষ ?” তৃতীয় বাহক বলিল, “মানুষঢ়টে ভারী জোয়ান ।” ৪র্থ। হাতে লাঠি দেখছি না ? ১ম। চক্রবর্তী মশাই কি বলেন ? আর ত এগোনে। ধায় না।--ডাকাতের হাতে প্রাণট। যাবে ? চক্ৰবৰ্ত্তী মহাশয় বলিলেন, “তাই ত, বড় বিপদ দেখি যে ! যা ভেবেছিলাম, তাই হলে !" এমন সময়ে যে দুই ব্যক্তি আসিতেছিল, তাহারা পথে লোক দেখিয়৷ হাকিল, “কোন হ্যায় রে ?” বেহারারা আমনি পান্ধী মাটীতে ফেলিয়া দিয়া “বাবা গো” শব্দ করিয়া একেবারে জঙ্গলের ভিতর পলাইল । দেখিয়া ফুলভ চক্ৰবৰ্ত্তী মহাশয়ও সেই পথাবলম্বী হইলেন। তখন ফুলমণি “আমায় ফেলে কোথায় যাও ?” বলিয়া তার পাছু পাছু ছুটিল । যে দুই জন আসিতেছিল—যাহার এই দশ জন মনুষ্যের ভয়ের কারণ—তাহারা পথিক মাত্র। দুই জুন হিন্দুস্থানী দিনাজপুরের রাজসরকারে চাকুরীর চেষ্টায় যাইতেছে । রাত্রি প্রভাত নিকটে দেখিয়া সকালে সকালে পথ চলিতে আরম্ভ করিয়াছে । বেহারার পলাইল দেখিয়া তাহারা একবার খুব হাসিল ; তার পর আপনাদের গন্তব্য পথে চলিয়া গেল। কিন্তু বেহারারা, আর ফুলমণি ও চক্ৰবৰ্ত্তী মহাশয় আর পাছু ফিরিয়া চাহিল না। ృ(t প্রফুল্ল পান্ধীতে উঠিয়াই মুখের বাধন স্বহস্তে খুলিয়া ফেলিয়াছিল । রাত্রি দুই প্রহরে চীৎকার করিয়া কি হইবে বলিয়া চীৎকার করে নাই ; চীৎকার শুনিতে পাইলেই বা কে ডাকাতের সম্মুখে আসিবে ? : প্রথমে ভয়ে প্রফুল্ল কিছু আত্মবিস্তৃত হইয়াছিল, কিন্তু এখন প্রফুল্ল স্পষ্ট বুঝিল যে, সাহস না করিলে মুক্তির কোন উপায় নাই । যখন বেহারার পান্ধী ফেলিয়া পলাইল, তখন প্রফুল্ল বুঝিল-এ আবার কি নুতন বিপদ ! ধীরে ধীরে পান্ধীর কপাট পুলিল। অল্প মুখ বাড়াইয়া দেখিল, কৃষ্ট জন মনুষ্য আসিতেছে । তখন প্রফুল্ল ধীরে ধীরে কপাট বন্ধ করিল ; যে অল্প কঁকে রহিল, তাহ দিয়া প্রফুল্ল দেখিল, মচুন্য তুই জন চলিয়া গেল। তখন প্রফুল্ল পান্ধী হইতে বাহির হইল —দেখিল, কেহ কোথাও নাই । প্রফুল্ল ভাবিল, যাহারা আমাকে চুরি করিয়া লইয়। যাইতেছিল, তাহারা অবশ্য ফিরিবে ; অতএব যদি পথ ধরিয়া যাই, তবে ধরা পড়িতে পারি। তার চেয়ে এখন জঙ্গলের ভিতর লুকাইয়া থাকি । তার পর, দিন হইলে যা হয় করিব । এই ভাবিয়া প্রফুল্ল জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিল। ভাগ্যক্রমে ষে দিকে বেহারারা পলাইয়াছিল, সে দিকে যায় নাই ; সুতরাং কাহারও সঙ্গে তাহার সাক্ষাৎ হইল না। প্রফুল্ল জঙ্গলের ভিতর স্থির হইয়। দাড়াইয়া রহিল । অল্পক্ষণ পরেই প্রভাত হইল । প্রভাত হইলে প্রফুল্ল বনের ভিতর এদিক্‌ ওদিকৃ বেড়াইতে লাগিল—পথে বাহির হইতে এখনও সাহস হয় না । দেখিল, এক জায়গায় একট। পথের অস্পষ্ট রেখা বনের ভিতরের দিকে গিয়াছে । যখন পথের রেখা এ দিকে গিয়াছে, তখন অবশ্য এ দিকে মানুষের বাস আছে। প্রফুল্ল সেই পথে চলিল । বাড়ী ফিরিয়া যাইতে ভয়, পাছে বাড়ী হইতে আবার তাকে ডাকাইতে ধরিয়া আনে । বাঘভালুকে খায়, সেও ভাল, আর ডাকাইতের হাতে না পড়িতে হয় । পথের রেখ। ধরিয়া প্রফুল্ল অনেক দূর গেল। বেলা দশ দণ্ড হইল, তবু গ্রাম পাইল না । শেষে পথের রেখা বিলুপ্ত হইল—আর পথ পায় না। কিন্তু দুই একখানা পুরাতন ইট দেখিতে পাইল । ভরস পাইল । মনে করিল, যদি ইট আছে, তবে অবশ্য নিকটে মনুস্যালয় আছে । যাইতে যাইতে ইটের সংখ্যা বাড়িতে লাগিল । জঙ্গল দুর্ভেদ্য হইয়। উঠিল; শেষে প্রফুল্ল দেখিল, নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে এক বৃহৎ অট্রালিকার ভগ্নাবশেষ রহিয়াছে। প্রফুল্ল ইষ্টকস্ত পের উপর আরোহণ