পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/২৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

p দেবী চৌধুরাণী ৰপিয়াছিলাম। ছিপ আসিতেছে দেখিয়া আমি ভেরী ৰাজাইয়া সঙ্কেত করিয়াছি । দেবী ৷ ও জঙ্গলেও সিপাহী আছে ? রঙ্গ । তাহদের আমরা ঘেরিয়া ফেলিয়াছি । দেবী । ঠাকুরজি কোথায় ? রঙ্গ । ঐ বরকন্দাজ লইয়া বাহির হইতেছেন । দেবী । তোমরা কত বরকন্দাজ আনিয়াছ ? রঙ্গ। প্রায় হাজার হইবে । দেবী । সিপাহী কত ? রঙ্গ শুনিয়াছি পচি শ । দেবী । এই পনের শ লোকের লড়াই হইলে মরিবে কত ? রঙ্গ । তা দুই চারি শ মরিলেও মরিতে পারে । দেবী। ঠাকুরজিকে গিয়া বল—তুমিও শোন যে, তোমাদের এই আচরণে আমি আজ মৰ্ম্মাস্তিক মনঃপীড়া পাইলাম । রঙ্গ ৷ কেন, মা ? দেবী । একটা মেয়েমানুষের প্রাণের জন্য এত লোক তোমরা মরিবার বাসনা করিয়াছ-তোমাদের কি কিছু ধৰ্ম্মজ্ঞান নাই ? অামার পরমায়ু শেষ হইয়া থাকে, আমি এক মরিব—আমার জন্য চারি শ লোক কেন মরিবে ? অামায় কি তোমরা এমন অপদার্থ ভাবিয়াছ যে, আমি এত লোকের প্রাণ নষ্ট করিয়া আপনার প্রাণ বঁাচাইব ? রঙ্গ । আপনি বাচিলে অনেক লোকের প্রাণরক্ষা হইবে । দেবী রাগে, ঘৃণায় অধীর হইয়া বলিল, “ছি !” সেই ধিক্কারে রঙ্গরাজ অধোবদন হইল—মনে করিল, ‘পৃথিবী দ্বিধা হউক, আমি প্রবেশ করি । দেবী তখন বিস্ফারিত নয়নে ঘৃণা-ফুরিত কম্পিতী ধরে বলিতে লাগিল, “শোন, রঙ্গরাজ ! ঠাকুরজিকে গিয়া বল, এই মুহূৰ্ত্তে বরকন্দাজ-সকল ফিরাইয়া লইয়। যাউন । তিলাৰ্দ্ধ বিলম্ব হইলে আমি এই জলে ঝাপ দিয়া মরিব, তোমরা কেহ রাখিতে পরিবে না ।” রঙ্গরাজ এতটুকু হইয়া গেল । বলিল, “আমি • চলিলাম। ঠাকুরজিকে এই সকল কথা জানাইব । তিনি যাহা ভাল বুঝিবেন, তাহা করিবেন। আমি উভয়েরই আজ্ঞাকারী ।” রঙ্গরাজ চলিয়া গেল। নিশি ছাদে দাড়াইয়া সব শুনিয়াছিল। রঙ্গরাজ চলিয়া গেলে, সে দেবীকে বলিল, “ভাল, তোমার প্রাণ লইয়া তুমি যাহা ইচ্ছা করিতে পার, কাহারও নিষেধ করিবার অধিকার

  1. లి -త్రిశి

(t૧ নাই। কিন্তু আজ তোমার সঙ্গে তোমার স্বামী— র্তার জন্তেও ভাবিলে না ?” দেবী। ভাবিয়াছি ভগিনি । ভাবিয়া কিছু করিতে পারি নাই । জগদীশ্বর মাত্র ভরসা ! যা হইবার হইবে । কিন্তু যাই হউক, নিশি–এক কথা সার । আমার স্বামীর প্রাণ বঁাচাইবার জন্য এত লোকের প্রাণ নষ্ট করিবার আমার কোন অধিকার নাই । আমার স্বামী আমার বড় আদরের—তাদের কে ? নিশি মনে মনে দেবীকে ধন্য ধন্য বলিল। ভাবিল, “এই সার্থক নিষ্কাম ধৰ্ম্ম শিথিয়াছিল । ইহার সঙ্গে মরিয়াও সুখ ।” নিশি গিয়া সকল কথ। ব্রজেশ্বরকে শুনাইল । ব্ৰজেশ্বর প্রফুল্লকে আর আপনার স্ত্রী বলিয়া ভাবিতে পারিল না ; মনে মনে বলিল, “যথার্থ দেবীই বটে । আমি নরাধম, আমি আবার ইহাকে ডাকাইত বলিয়া ভৎসনা করিতে গিয়াছিলাম !” এ দিকে পাচ দিক্ হইতে পাচখানা ছিপ আসিয়া বজরার নিকটবৰ্ত্তী হইল। প্রফুল্ল সে দিকে দৃকপাতও করিল না, প্রস্তরময়ী মূৰ্ত্তির মত নিম্পন্দশরীরে ছাদের উপরে বসিয়া রহিল । প্রফুল্ল ছিপ দেখিতেছিল না— বরকন্দাজ দেখিতেছিল না। দূর আকাশপ্রান্তে তাহার দৃষ্টি । আকাশপ্রাস্তে একখান ছোট মেঘ অনেকক্ষণ হইতে দেখা দিয়াছিল। প্রফুল্ল তাই দেখিতেছিল । দেখিতে দেখিতে বোধ হইল, যেন, সেখান একটু বাড়িল । তখন “জয় জগদীশ্বর ” বলিয়া প্রফুল্ল ছাদ হইতে নামিল । প্রফুল্লকে ভিতরে আসিতে দেখিয়া, নিশি জিজ্ঞাসা করিল, “এখন কি করিবে ?” প্রফুল্ল বলিল, “আমার স্বামীকে বাচাইব ।” নিশি। আর তুমি ? দেবী ৷ আমার কথা আর জিজ্ঞাসা করিও না । আমি যাহা বলি, যাহা করি, এখন তাহাতে বড় সাবধানে মনোযোগ দাও । তোমার আমার অদৃষ্টে যাই হউক, আমার স্বামীকে বাচাইতে হইবে, দিবাকে বঁাচাইতে হইবে, শ্বশুরকে ধাচাইতে হুইৰে । এই বলিয়া দেবী একটা শাক লইয়। ফু দিল । নিশি বলিল, “তবু ভাল।” দেবী বলিল, “ভাল কি মন্দ, বিবেচনা করিয়া দেখ । যাহা যাহা করিতে হইবে, তোমাকে বলিয়া দিতেছি । তোমার উপর সব নির্ভর ।”