পাতা:বিভূতি রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড).djvu/২৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

১২ বিভূতি-রচনাবলী শরতের কটুতিক্ত গন্ধ ওঠা বনঝোপ ও মাকাললতা দোলানো একটা প্রাচীন তিত্তিরাজ গাছের তলায় বুদ্ধাকে কবর দেওয়া হচ্ছে। আমি গিয়ে বসলাম। আবদুল শুকুর মিঞা, নমর আমাদের সঙ্গে পড়তো আবেদালি, তার ছেলে গনি—এরা সকলে গাছের ছায়ায় ব'সে। প্রবীণ শুকুর মিঞা আমায় দেখে বল্লে—এই যে বাবাঠাকুর, এসো। তামুক খাবা? বুড়ীর মাটি দেওয়ার দিন তুমি কনে থেকে এলে, তুমি তো জানতে না? তোমায় যে বড্ড ভালবাসতো বুড়ী। তোমার কাছে কাফনের কাপড় নিয়ে তবে ওর মহাপ্রাণীডা ঠাণ্ডা হলো। খাও তামুক— একটি গরুর গাড়ীর পুরনো কাঠামোর ওপর বৃদ্ধাকে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুইয়ে রেখেচে। দুজন জোয়ান ছেলে কবর খুঁড়চে। কবর দেওয়ার পরে সকলে এক এক কোদাল মাটি দিলে কবরের ওপর। শুকুর মিঞা বল্লে—দ্যাও বাবাঠাকুর, তুমিও দ্যাও—তুমি দিলে মহাপ্রাণী ঠাণ্ডা হবে— দিলাম এক কোদাল মাটি। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, ও বেঁচে থাকলে বলে উঠতো—অ মোর গোপাল।

একটি ভ্রমণ-কাহিনী আপিসে পানের আর জর্দার কৌটো দুই-ই ফেলে এসেছেন গোপীকৃষ্ণবাবু। বৌবাজারের মোড়ে এসে মনে পড়লো। ছাতিটা আজ আবার আনেননি, বৃষ্টি হবে না ধারণা ছিল, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ছাতি না এনে ভুল করেছেন, মেঘ জমে আছে সেণ্ট্রাল এভিনিউর বড় বড় বাড়ীগুলোর মাথায়। পানের কৌটো ফেলা চলে না, টেবিল থেকে কে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। আবার আপিসে ফিরলেন, ইনচার্জবাবু তখনও কাজ করছেন একমনে, অথচ কেউ নেই ডিপার্টমেণ্টে, খোশামুদে কোথাকার, মরুক খেটে! দেড়শো টাকা মাইনের মত কাজ দেখানো চাই তো সাহেবদের, নইলে যদি তাড়িয়ে দেয়? দিনকাল ভাল না। তাঁদের যে পঞ্চাশটি টাকা সেই পঞ্চাশটি টাকা। কেউ নেবে না, কেউ বাড়তি দেবেও না। এই যুদ্ধের বাজার। চালানো যে কত দায় হয়ে উঠেছে, সে বোঝে যে চালায়। পঞ্চাশটি টাকা মাইনে, একপয়সা উপরি নেই। ওভারটাইম খাটলে একটাকা দৈনিক পাওয়া যায় বটে, কিন্তু ওভারটাইম ক’দিন হয় মাসে? আপিস থেকে রেশন দেয় তাই রক্ষে, নইলে না খেয়ে মরতে হতো সপরিবারে। খিদে পেয়েছে বড়। মোড়ের ওই দোকানখানায় এবার পানের কৌঁটো নিতে আসবার সময় দেখে এসেছেন বেশ বড় বড় কচুরী ভাজছে। নিশ্চয় চার পরসায় একখানা। খেতে ইচ্ছে তো হয়, পয়সায় কুলোয় কই? একটা দোকানে বসে আধ পোলাচা দু পয়সা দিয়ে কিনে খেয়ে একটা বিড়ি ধরিয়েই জাপাতত খিদের শাস্তি করলেন গোপীকৃষ্ণবাবু।