পাতা:বিভূতি রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড).djvu/৪১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

% o o বিভূতি-রচনাবলী তোর 1 তখনও তাহার সেই গৃহে দেবীর পদ্মগন্ধ বিচ্ছুরিত হইতেছিল। শঙ্করনারায়ণ বিচলিত হইলেন না। চৌধুরীবংশ তাহার পুত্রের চেয়ে অধিক মূল্যবান। তিনি বলিলেন, তাই হবে মা, তাই হবে । তুমি এ অভাগাকে ত্যাগ করো না। * তার পর তিনি ধীরপদক্ষেপে র্তাহার শয়নগৃহে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, অতি সস্তপণে । কল্যাণী তখন ঘুমাইতেছিলেন আর র্তাহার পুত্র মাতার স্তন্যপান করিতেছিল ঘুমন্ত অবস্থায়। শঙ্করনারায়ণ অত্যন্ত ধীরে ধীরে সেই খোকাকে মাতার বক্ষ হইতে ছিনাইয়া জানিলেন । কল্যাণী সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত হইয়। ঘুমাইতেছিলেন। তিনি একবার পাশ ফিরিয়া শুইলেন মাত্র। শঙ্করনারায়ণ খোকাকে পরম স্নেহে তাহার বুকের মধ্যে করিয়া গৃহ হইতে বাহির হইয়া আসিলেন । সেঁ-সো শব্দে সারা প্রকৃতি যেন উন্মাদ তাওবে মাতিয়া উঠিয়াছিল। খোকা পিতার বাহুমধ্যে ঘুমাইতে লাগিল। তার পর খোকাকে গৃহদেবীর সন্মুখে নিজ হাতে বলি দিলেন । একবার হয়তো সে কাদিয়াছিল ; কিন্তু বাহিরের সেই ঝড়জলের মধ্যে সে কান্না হয়তো শোনা যায় নাই । রক্তধারায় সার-গৃহ ছাইয়া গেল। ভয়ে বিস্ময়ে তিনি কিন্তু দিশাহারা হইলেন না বা বেদনায় মুম্বড়াইয়া পড়িলেন না। হোমের জন্য যে বালি ছিল তাহা আনিয়া সারারাত্রি তিনি সেই রক্তচিহ্ন মুছিতে লাগিলেন। চৌধুরীবংশ বড় হুইবে জীবনের এই একমাত্র আকাজ আজ তাহার পূরণ হইয়াছে, এই সাত্ত্বনার পরম তৃপ্তিতে সেই বালির উপরই রাত্রিশেষের দিকে তিনি ঘুমাইয়া পড়িলেন। দিনের আলো ফুটিতে না ফুটিতে কল্যাণী উন্মাদিনীর ন্যায় ছুটিয়া আসিয়া স্বামীকে জাগাইলেন, ওগো, খোকা কোথা গেল ? শঙ্করনারায়ণ স্ত্রীর পানে চাহিতে পারিলেন না। খোকার মৃতদেহ তখন ভাগীরথীর খরস্রোতে কোন দূরাস্তরে ভাসিয়া গিয়াছে। সেই রক্তমাখা বালুকারাশিই তাহার শেষ চিহ্ন। কল্যাণী আবার ডাকিলেন, ওগো, কথা কও, কথা কও ! আমার খোকাকে এনে দাও ! শঙ্করনারায়ণ আর কোন কথা বলিতে পারিলেন না। জীবনে আর তিনি খুব কমই কথা বলেন। যাহা হৌক ব্যাপারটা আর চাপ রহিল না । বুদ্ধিমতী কল্যাণী ক্রমে ক্রমে সমস্ত ব্যাপারই অবগত হইলেন। সারাদিন তিনি আর উঠলেন না, খাইলেন না। সেইদিন রাত্রে তিনিও কুলপ্লাবিনী জাহ্নবীর পুণালোতে আত্মবিসর্জন দিয়া তাহার বড় আদরের খোকায় সহিত মিলিত হইলেন। ব্যাপারটা ক্রমে ক্রমে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল । এ ঘটনার কিছুদিন পর শঙ্করনারায়ণ চৌধুরীকেও আর পাওয়া গেল না। আজ পৰ্য্যন্ত র্তাহাকে পাওয়া যায় নাই।-- সে আজ পঞ্চাশ বছরের কথা। গৃহলক্ষ্মী এখনও সেই ভগ্নপ্রায় বংশহীন চৌধুরী বাড়ীর অন্তরালে বন্দিনী আছেন কিনা জানি না । তবে মাঝে মাঝে ঐ ধ্বংসস্তুপের মধ্য হইতে একটা চাপা হামি পরম পরিতৃপ্তির সহিত বাহির হইয়া আলে। সেনি এমনি বড় উঠাছিল। সেদিনও পশ্চিমের আকাশে একটা কালো মেঘ দিগন্ত ছাইয়া রহিয়া রহিয়া কাদিয়া মরিতেছিল, সেদিনও হয়তো ঐ শ্মশানঘাটের নিম্পত্র ঝাউগাছটার মাথায় বসিয়া একটা শকুন আর্তকণ্ঠে চীৎকার কৱিা মরিতেছিল।