বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।

 প্রতাপাদিত্য ঘুম ভাঙিয়া উচ্চস্বরে ডাকিলেন “প্রহরি।” যখন প্রহরী আসিল না, তখন অবিলম্বে শয্যা ত্যাগ করিয়া তিনি বিদ্যুদ্বেগে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। ডাকিলেন, “মন্ত্রী।” একজন ভৃত্য ছুটিয়া গিয়া অবিলম্বে মন্ত্রীকে অন্তঃপুরে ডাকিয়া আনিল।

 “মন্ত্রী, প্রহরীরা কোথায় গেল?”

 মন্ত্রী কহিলেন—"বহির্দ্বারের প্রহরীরা পলাইয়া গেছে।” মন্ত্রী দেখিলেন, মাথার উপরে বিপদ ঘনাইয়া আসিয়াছে। এই নিমিত্ত প্রতাপ আদিত্যের কথার স্পষ্ট, পরিষ্কার ও দ্রুত উত্তর দিলেন। যতই ঘুরাইয়া ও যতই বিলম্ব করিয়া তাঁহার কথার উত্তর দেওয়া হয়, ততই তিনি আগুন, হইয়া উঠিতে থাকেন।

 প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “অন্তঃপুরের প্রহরীরা?”

 মন্ত্রী কহিলেন—“আসিবার সময় দেখিলাম তাহারা হাত পা বাঁধা পড়িয়া আছে।” মন্ত্রী রাত্রির ব্যাপার কিছুই জানিতেন না! কি হইয়াছে কিছু অনুমান করিতে পারিতেছেন না, অথচ বুঝিয়াছেন, একটা কি ঘােরতর ব্যাপার ঘটিয়াছে। সে সময়ে মহারাজকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা অসম্ভব।

 প্রতাপাদিত্য তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন—“রামচন্দ্র রায় কোথায়? উদয়াদিত্য কোথায়? বসন্তরায় কোথায়?”

 মন্ত্রী ধীরে ধীরে কহিলেন, “বােধ করি তাঁহারা অন্তঃপুরেই আছেন!”

 প্রতাপাদিত্য বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “বােধ ত আমিও করিতে পারিতাম! তােমাকে জিজ্ঞাসা করিলাম কি করিতে! যাহা বােধ করা যায় তাহা সকল সময়ে সত্য হয় না!”

 মন্ত্রী কিছু না বলিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেলেন। রমাপতির কাছে রাত্রের ঘটনা সমস্তই অবগত হইলেন। যখন শুনিলেন, রামচন্দ্র রায় পালাইয়া গেছেন, তখন তাঁহার বিশেষ ভাবনা উপস্থিত হইল। মন্ত্রী বাহিরে গিয়া দেখিলেন, খর্ব্বকায় রমাই ভাঁড় গুঁড়ি মারিয়া বসিয়া আছে। মন্ত্রীকে দেখিয়া রমাই ভাঁড় কহিল “এই যে মন্ত্রী জাম্বুবান!” বলিয়া দাঁত বাহির করিল। তাহার সেই দন্তপ্রধান হাস্যকে রামচন্দ্রের সভাসদেরা রসিকতা বলিত, বিভীষিকা বলিত না! মন্ত্রী তাহার সাদর সম্ভাষণ শুনিয়া কিছুই বলিলেন না, তাহার প্রতি দৃকপাতও করিলেন না। একজন ভৃত্যকে কহিলেন “ইহাকে লইয়া আয়!” মন্ত্রী ভাবিলেন, এই অপদার্থটাকে এই বেলা প্রতাপাদিত্যের ক্রোধের সামনে খাড়া করিয়া দিই। প্রতাপাদিত্যের বজ্র একজন না এক জনের উপরে পড়িবেই—তা’ এই কলাগাছটার উপরেই পড়ুক, বাকি বড় বড় গাছ রক্ষা পাক্!

 রমাইকে দেখিয়াই প্রতাপাদিত্য একেবারে জ্বলিয়া উঠিলেন— বিশেষতঃ সে যখন প্রতাপাদিত্যকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য দাঁত বাহির করিয়া, অঙ্গভঙ্গী করিয়া একটা হাস্য রসের কথা কহিবার উপক্রম করিল, তখন প্রতাপাদিত্যের আর সহ্য হইল না, তিনি অবিলম্বে আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া, দুই হাত নাড়িয়া দারুণ ঘৃণায় বলিয়া উঠিলেন, “দূর কর, দূর কর উহাকে এখনি দূর করিয়া দাও! ওটাকে আমার সম্মুখে আনিতে কে কহিল?” প্রতাপাদিত্যের রাগের সহিত যদি ঘৃণার উদয় না হইত, তবে রমাই ভাঁড় এ যাত্রা পরিত্রাণ পাইত না! কেন না ঘৃণ্য ব্যক্তিকে প্রহার করিতে গেলেও স্পর্শ করিতে হয়। রমাইকে তৎক্ষণাৎ বাহির করিয়া দেওয়া হইল।

 মন্ত্রী কহিলেন, “মহারাজ, রাজজামাতা,”

 প্রতাপাদিত্য অধীর ভাবে মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “রামচন্দ্র রায়—”

 মন্ত্রী কহিলেন, “হাঁ, তিনি কাল রাত্রে রাজপুরী পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন।”

 প্রতাপাদিত্য দাঁড়াইয়া উঠিয়া কহিলেন, “পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন! প্রহরীরা গেল কোথায়?”

 মন্ত্রী পুনরায় কহিলেন, “বহির্দ্বারের প্রহরীরা পালাইয়া গেছে।”

 প্রতাপাদিত্য মুষ্টিবদ্ধ করিয়া কহিলেন “পালাইয়া গেছে? পালাইবে কোথায়? যেখানে থাকে তাহাদের খুঁজিয়া আনিতে হইবে! অন্তঃপুরের প্রহরীদের এখনি ডাকিয়া লইয়া এস!” মন্ত্রী বাহির হইয়া গেলেন।

 রামচন্দ্র রায় যখন নৌকায় চড়িলেন, তখনাে অন্ধকার আছে। উদয়াদিত্য, বসন্তরায়, সুরমা ও বিভা, সে রাত্রে আসিয়া আর বিছানায় শুইল না। বিভা একটি কথা না বলিয়া, একটি অশ্রু না ফেলিয়া অবসন্ন ভাবে শুইয়া রহিল, সুরমা তাহার কাছে বসিয়া তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। উদয়াদিত্য ও বসন্তরায় চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। অন্ধকার ঘরে পরস্পরের মুখ অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাইতেছে। ঘরের মধ্যে যেন অদৃশ্য একজন কে — অন্ধকার বল, আশঙ্কা বল, অদৃষ্ট বল—বসিয়া আছে, তাহার নিশ্বাস পতনের শব্দ শুনা যাইতেছে। সদানন্দহৃদয় বসন্তরায় চারিদিকে নিরানন্দ দেখিয়া একেবারে আকুল হইয়া পড়িয়াছেন। তিনি অনবরত টাকে হাত বুলাইতেছেন, চারিদিক দেখিতেছেন ও ভাবিতেছেন—এ কি হইল! তাঁহার গােলমাল ঠেকিয়াছে, চারিদিককার ব্যাপার ভালরূপ আয়ত্ত করিতে পারিতেছেন না। সমস্ত ঘটনাটা তাঁহার একটা জটিল দুঃস্বপ্ন বলিয়া মনে হইতেছে। এক একবার বসন্তরায় উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া কাতর স্বরে কহিতেছেন, “দাদা!” উদয়াদিত্য কহিতেছেন “কি দাদামহাশয়?” তাহার উত্তরে বসন্তরায়ের আর কথা নাই। ঐ এক “দাদা” সম্বােধনের মধ্যে একটি আকুল দিশাহারা হৃদয়ের বাক্যহীন সহস্র অব্যক্ত প্রশ্ন প্রকাশ পাইবার জন্য আঁকুবাঁকু করিতেছে। তাঁহার বিশেষ একটা কোন প্রশ্ন নাই, তাহার সমস্ত কথার অর্থ এই—এ কি? চারিদিককার অন্ধকার এমনি গােলমাল করিয়া একটা কি ভাষায় তাঁহার কানের কাছে কথা কহিতেছে, তিনি কিছুই বুঝিতে পারিতেছেন না। এমন সময়ে উদয়াদিত্যের সাড়া পাইলেও তাঁহার মনটা একটু স্থির হয়। থাকিয়া থাকিয়া তিনি সকাতরে উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া কহিলেন, “দাদা, আমার জন্যই কি এ সমস্ত হইল?” তাঁহার বার বার মনে হইতেছে তাঁহাকে বিনাশ করিতে না পারাতেই এই সমস্ত ঘটিয়াছে। উদয়াদিত্যের তখন অধিক কথা কহিবার মত ভাব নহে। তিনি কোমল স্বরে কহিলেন, “না দাদামহাশয়!” অনেকক্ষণ ঘর নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। থাকিয়া থাকিয়া বসন্তরায় আবার বলিয়া উঠিলেন, “বিভা, দিদি আমার, তুই কথা কহিতেছিস্ না কেন?” বলিয়া বসন্তরায় বিভার কাছে গিয়া বসিলেন। কিছুক্ষণ পরে বসন্তরায় আবার বলিয়া উঠিলেন, “সুরমা, ও সুরমা!” সুরমা মুখ তুলিয়া চাহিল, আর কিছু বলিল না। বৃদ্ধ বসিয়া বসিয়া মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন। একটা অনির্দ্দেশ্য বিপদের প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন। সুরমা তখন স্থিরভাবে বসিয়া বিভার কপালে হাত বুলাইতেছিল, কিন্তু সুরমার হৃদয়ে যাহা হইতেছিল, তাহা অন্তর্যামীই দেখিতেছিলেন। সুরমা সেই অন্ধকারে একবার উদয়াদিত্যর মুখের দিকে চাহিল। তখন উদয়াদিত্য দেয়ালে মাথা রাখিয়া এক মনে কি ভাবিতেছিলেন। সুরমার দুই চক্ষু রহিয়া অশ্রুজল পড়িতে লাগিল। আস্তে আস্তে মুছিয়া ফেলিল, পাছে বিভা জানিতে পায়।

 যখন চারিদিক আলাে হইয়া আসিল তখন বসন্তরায় নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিলেন। তখন তাঁহার মন হইতে একটা অনির্দ্দেশ্য আশঙ্কার ভাব দূর হইল। তখন স্থির চিত্তে সমস্ত ঘটনা একবার আলোচনা করিয়া দেখিলেন। তিনি বিভার ঘর হইতে উঠিয়া গেলেন। অন্তঃপুরের দ্বারে হাত পা বাঁধা সীতারামের কাছে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তাহাকে কহিলেন, “দেখ্ সীতারাম, তােকে যখন প্রতাপ জিজ্ঞাসা করিবে, কে তােকে বাঁধিয়াছে, তুই আমার নাম করিস্। প্রতাপ জানে, এক কালে বসন্তরায় বলিষ্ঠ ছিল, সে তাের কথা বিশ্বাস করিবে।”

 সীতারাম, প্রতাপাদিত্যের কাছে কি জবাব দিবে, এতক্ষণ ধরিয়া তাহাই ভাবিতেছিল। এ সম্বন্ধে উদয়াদিত্যের নাম করিতে কোন মতেই তাহার মন উঠিতেছিল না। সে একটা বাঁকা পা তিনচোখো তালবৃক্ষাকৃতি ভূতকে আসামী করিবে বলিয়া একবার স্থির করিয়াছিল, কিন্তু বসন্তরায়কে পাইয়া নিরপরাধ ভূতটাকে খালাস দিল। বসন্তরায়ের কথায় সে তৎক্ষণাৎ রাজি হইল। তখন তিনি দ্বিতীয় প্রহরীর নিকট গিয়া কহিলেন, “ভাগবত, প্রতাপ জিজ্ঞাসা করিলে বলিও বসন্তরায় তােমাকে বাঁধিয়াছে।” সহসা ভাগবতের ধর্ম্মজ্ঞান অত্যন্ত প্রবল হইয়া উঠিল, অসত্যের প্রতি নিতান্ত বিরাগ জন্মিল; তাহার প্রধান কারণ, উদয়াদিত্যের প্রতি সে ভারি ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিয়াছিল।

 ভাগবত কহিল, “এমন কথা আমাকে আদেশ করিবেন না, ইহাতে আমার অধর্ম্ম হইবে।”

 বসন্ত তাহার কাঁধে হাত দিয়া কহিলেন, “ভাগবত আমার কথা শুন; ইহাতে কোন অধর্ম্ম নাই। সাধু লােকের প্রাণ বাঁচাইতে মিথ্যা কথা বলিতে যদি কোন অধর্ম্ম থাকিবে, তবে আমি কেন তােমাকে এমন অনুরােধ করিব?” বসন্তরায় তাহার কাঁধে হাত দিয়া পিঠে হাত দিয়া বার বার করিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন, ইহাতে কোন অধর্ম্ম নাই। কিন্তু লােকের যখন ধর্ম্মজ্ঞান সহসা বিশেষ প্রবল হইয়া উঠে, তখন কোন যুক্তিই তাহার কাছে খাটে না। সে কহিল, “না, মহারাজ, মনিবের কাছে মিথ্যা কথা বলিব কি করিয়া!”

 বসন্তরায় বিষম অস্থির হইয়া উঠিলেন; ব্যাকুলভাবে কহিলেন, “ভাগবত, আমার কথা শুন, আমি তােমাকে বুঝাইয়া বলি, এ মিথ্যা কথায় কোন পাপ নাই। দেখ বাপু, আমি তােমাকে পরে খুব খুসী করিব, তুমি আমার কথা রাখ। এই লও আমার কাছে যাহা আছে, এই দিলাম।”

 ভাগবত তৎক্ষণাৎ হাত বাড়াইল, ও সেই টাকাগুলি মুহূর্ত্তের মধ্যে তাহার ট্যাঁকে আশ্রয় লাভ করিল। বসন্তরায় কিয়ৎ পরিমাণে নিশ্চিন্ত হইয়া ফিরিয়া গেলেন।

 প্রতাপাদিত্যের নিকট প্রহরীদ্বয়ের ডাক পড়িয়াছে। মন্ত্রী তাহাদিগকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেলেন। প্রতাপাদিত্য তখন তাঁহার উচ্ছ্বসিত ক্রোধ দমন করিয়া স্থির গম্ভীর ভাবে বসিয়া আছেন। প্রত্যেক কথা ধীরে ধীরে স্পষ্টরূপে উচ্চারণ করিয়া কহিলেন, “কাল রাত্রে অন্তঃপুরের দ্বার খােলা হইল কি করিয়া?”

 সীতারামের প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল, সে যােড়হস্তে কহিল, “দোহাই মহারাজ, আমার কোন দোষ নাই।”

 মহারাজ ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া কহিলেন, “সে কথা তােকে কে জিজ্ঞাসা করিতেছে?”

 সীতারাম তাড়াতাড়ি কহিল, “আজ্ঞা না, বলি মহারাজ; যুবরাজ —যুবরাজ আমাকে বলপূর্ব্বক বাঁধিয়া অন্তঃপুর হইতে বাহির হইয়াছিলেন।” যুবরাজের নাম তাহার মুখ দিয়া কেমন হঠাৎ বাহির হইয়া গেল। ঐ নামটা কোন মতে করিবে না বলিয়া সে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ভাবিয়াছিল, এই নিমিত্ত গােলমালে ঐ নামটাই সর্ব্বাগ্রে তাহার মুখাগ্রে উপস্থিত হইল। একবার যখন বাহির হইল তখন আর রক্ষা নাই।

 এমন সময় বসন্তরায় শুনিলেন, প্রহরীদের ডাক পড়িয়াছে। তিনি ব্যস্তসমস্ত হইয়া প্রতাপাদিত্যের কক্ষে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন সীতারাম কহিতেছে “যুবরাজকে আমি নিষেধ করিলাম তিনি শুনিলেন না।”

 বসন্তরায় তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন “হাঁ হাঁ সীতারাম, কি কহিলি? অধর্ম্ম করিস্‌নে, সীতারাম, ভগবান্ তাের পরে সন্তুষ্ট হইবেন। উদয়াদিত্যের ইহাতে কোন দোষ নাই।”

 সীতারাম তাড়াতাড়ি বলিয়া ফেলিল, “আজ্ঞা না, যুবরাজের কোন দোষ নাই।”

 প্রতাপাদিত্য দৃঢ় স্বরে কহিলেন “তবে তাের দোষ?”

 সীতারাম কহিল “আজ্ঞা না।”

 “তবে কার দোষ?”

 “আজ্ঞা যুবরাজ—”

 ভাগবতকে যখন জিজ্ঞাসা করা হইল, তখন সে সমস্ত কথা ঠিক করিয়া কহিল, কেবল সে যে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল সেইটে গােপন করিল। বৃদ্ধ বসন্তরায় চারিদিক ভাবিয়া কোন উপায় দেখিলেন না। তিনি চোখ বুজিয়া মনে মনে দুর্গা দুর্গা কহিলেন। প্রহরীদ্বয়কে তৎক্ষণাৎ কর্ম্মচ্যুত করা হইল। তাহাদের অপরাধ এই যে তাহাদের যদি বলপূর্ব্বক বাঁধিতে পারা যায় তবে তাহারা প্রহরী-বৃত্তি করিতে আসিয়াছে কি বলিয়া? এই অপরাধের জন্য তাহাদের প্রতি কশাঘাতের আদেশ হইল।

 তখন প্রতাপাদিত্য বসন্তরায়ের মুখের দিকে চাহিয়া বজ্রগম্ভীর স্বরে কহিলেন, “উদয়াদিত্যের এ অপরাধের মার্জ্জনা নাই।” এমনি ভাবে বলিলেন যেন উদয়াদিত্যের সে অপরাধ বসন্তরায়েরই। যেন তিনি উদয়াদিত্যকে সম্মুখে রাখিয়াই ভর্ৎসনা করিতেছেন। বসন্তরায়ের অপরাধ, তিনি উদয়াদিত্যকে প্রাণের অধিক ভালবাসেন।

 বসন্তরায় তাড়াতাড়ি কহিয়া উঠিলেন “বাবা প্রতাপ, উদয়ের ইহাতে কোন দোষ নাই।”

 প্রতাপাদিত্য আগুন হইয়া কহিলেন “দোষ নাই? তুমি দোষ নাই বলিতেছ বলিয়াই তাহাকে বিশেষরূপে শাস্তি দিব! তুমি মাঝে পড়িয়া মীমাংসা করিতে আসিয়াছ কেন?”

 বসন্তরায় অত করিয়া উদয়াদিত্যের পক্ষ লইয়াছেন বলিয়াই প্রতাপাদিত্যের মন উদয়াদিত্যের বিশেষ বিপক্ষ হইয়া দাঁড়াইল। বসন্তরায় দেখিলেন, তাঁহাকে শাস্তি দিবার জন্যই পাছে উদয়াদিত্যকে শাস্তি দেওয়া হয়। চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন।

 কিয়ৎক্ষণ পরে শান্ত হইয়া প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “যদি জানিতাম, উদয়াদিত্যের কিছুমাত্র নিজের মনের জোর আছে, তাহার একটা মত আছে, একটা অভিপ্রায় আছে, যাহা করে, সব নিজে হইতেই করে, যদি না জানিতাম যে, সে নির্ব্বোধটাকে যে খুসী ফুঁ দিয়া উড়াইয়া বেড়াইতে পারে, কটাক্ষের সঙ্কেতে ঘুরাইয়া মারিতে পারে, তাহা হইলে তাহার আজ আর রক্ষা ছিল না। আমি যেখানে ঐ পালকটাকে উড়িতে দেখিয়াছি, নীচের দিকে চাহিয়া দেখিয়াছি ফুঁ দিতেছে কে! এই জন্য উদয়াদিত্যকে শাস্তি দিতে ইচ্ছা করে না। সে শাস্তিরও অযােগ্য। কিন্তু শােন, পিতৃব্য ঠাকুর, তুমি যদি দ্বিতীয়বার যশােহরে আসিয়া উদয়াদিত্যের সহিত দেখা কর, তাহার প্রাণ বাঁচান দায় হইবে।”

 বসন্তরায় অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন; পরে ধীরে ধীরে উঠিয়া কহিলেন—“ভাল প্রতাপ, আজ সন্ধ্যা বেলায় তবে আমি চলিলাম।” আর, একটি কথা না বলিয়া বসন্তরায় ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন, বাহির হইয়া গিয়া গভীর এক নিশ্বাস ফেলিলেন।

 প্রতাপাদিত্য স্থির করিয়াছেন, যে-কেহ উদয়াদিত্যকে ভালবাসে, উদয়াদিত্য যাহাদের বশীভূত, তাহাদিগকে উদয়াদিত্যের নিকট হইতে তফাৎ করিতে হইবে। মন্ত্রীকে কহিলেন, “বউমাকে আর রাজপুরীতে থাকিতে দেওয়া হইবে না, কোন সূত্রে তাহাকে তাহার বাপের বাড়ি পাঠাইতে হইবে।” বিভার প্রতি প্রতাপাদিত্যের কোন আশঙ্কা হয় নাই; হাজার হউক, সে বাড়ির মেয়ে!