ঘরে-বাইরে/১০

উইকিসংকলন থেকে

বিমলার আত্মকথা

সেই সময়ে হঠাৎ সমস্ত বাংলাদেশের চিত্ত যে কেমন হয়ে গেল তা বলতে পারি নে। ষাট হাজার সগরসন্তানের ছাইয়ের ’পরে এক মুহূর্তে যেন ভাগীরথীর জল এসে স্পর্শ করলে। কত যুগযুগান্তরের ছাই, রসাতলে পড়ে ছিল—কোনাে আগুনের তাপে জ্বলে না, কোনাে রসের মিশালে দানা বাঁধে না— সেই ছাই হঠাৎ একেবারে কথা কয়ে উঠল, বললে ‘এই-যে আমি’!

 বইয়ে পড়েছি, গ্রীস দেশের কোন্ মূর্তিকর দেবতার বরে আপনার মূর্তির মধ্যে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন কিন্তু সেই রূপের থেকে প্রাণের মধ্যে একটা ক্রমশ বিকাশ, একটা সাধনার যােগ আছে। কিন্তু আমাদের দেশের শ্মশানের ভস্মরাশির মধ্যে সেই রূপের ঐক্য ছিল কোথায়! সে যদি পাথরের মতাে আঁট শক্ত জিনিস হত তা হলেও তাে বুঝতুম অহল্যা পাষাণীও তাে একদিন মানুষ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এ-যে সব ছড়ানাে, এ-যে সৃষ্টিকর্তার মুঠোর ফাঁক দিয়ে কেবলই গলে গলে পড়ে, বাতাসে উড়ে উড়ে যায়। এ যে রাশ হয়ে থাকে, কিছুতে এক হয় না। অথচ সেই জিনিস হঠাৎ একদিন আমাদের ঘরের আঙিনার কাছে এসে মেঘগর্জনে বলে উঠল ‘অয়মহং ভােঃ’।

 তাই আমাদের সেদিন মনে হল, এ সমস্তই অলৌকিক। এই বর্তমান মুহূর্ত কোনাে সুধারসােন্মত্ত দেবতার মুকুটের থেকে মানিকের মতাে একেবারে আমাদের হাতের উপর খসে পড়ল; আমাদের অতীতের সঙ্গে আমাদের এই বর্তমানের কোনাে স্বাভাবিক পারম্পর্য নেই। এই দিনটি আমাদের সেই ওষুধের মতাে যা খুঁজে বের করি নি, যা কিনে আনি নি, যা কোনাে চিকিৎসকের কাছ থেকে পাওয়া নয়, যা আমাদের স্বপ্নলব্ধ। সেইজন্য মনে হল, আমাদের সব দুঃখ সব তাপ আপনি মন্ত্রে সেরে যাবে। সম্ভব-অসম্ভবের কোনাে সীমা কোথাও রইল না। কেবলই মনে হতে লাগল, এই হল বলে, হল বলে।

 আমাদের সেদিন মনে হয়েছিল, ইতিহাসের কোনাে বাহন নেই, পুষ্পক রথের মতাে সে আপনি চলে আসে। অন্তত তার মাতলিকে কোনাে মাইনে দিতে হয় না, তার খােরাকির জন্য কোনাে ভাবনা নেই, কেবল ক্ষণে ক্ষণে তার মদের পেয়ালা ভর্তি করে দিতে হয়— আর, তার পরেই হঠাৎ একেবারে সশরীরে স্বর্গপ্রাপ্তি।

 আমার স্বামী যে অবিচলিত ছিলেন তা নয়। কিন্তু সমস্ত উত্তেজনার মধ্যে তাঁকে যেন একটা বিষাদ এসে আঘাত করত। যেটা সামনে দেখা যাচ্ছে তার উপর দিয়েও তিনি যেন আর-একটা-কিছুকে দেখতে পেতেন। মনে আছে সন্দীপের সঙ্গে তর্কে তিনি একদিন বলেছিলেন, সৌভাগ্য হঠাৎ এসে আমাদের দরজার কাছে হাঁক দিয়ে যায় কেবল দেখাবার জন্যে যে তাকে গ্রহণ করবার শক্তি আমাদের নেই, তাকে ঘরের মধ্যে নিমন্ত্রণ করে বসাবার কোনাে আয়ােজন আমরা করি নি।

 সন্দীপ বললেন, দেখাে নিখিল, তুমি দেবতাকে মানো না, সেইজন্যেই এমন নাস্তিকের মতাে কথা কও। আমরা প্রত্যক্ষ দেখছি দেবী বর দিতে এসেছেন। আর, তুমি অবিশ্বাস করছ!

 আমার স্বামী বললেন, আমি দেবতাকে মানি, সেইজন্যেই অন্তরের মধ্যে নিশ্চিত জানি তাঁর পূজা আমরা জোটাতে পারলুম না। বর দেবার শক্তি দেবতার আছে, কিন্তু বর নেবার শক্তি আমাদের থাকা চাই।

 আমার স্বামীর এইরকমের কথায় আমার ভারি রাগ হত। আমি তাঁকে বললুম, তুমি মনে কর দেশের এই উদ্দীপনা, এ কেবলমাত্র একটা নেশা। কিন্তু নেশায় কি শক্তি দেয় না?

 তিনি বললেন, শক্তি দেয়, কিন্তু অস্ত্র দেয় না।

 আমি বললুম, শক্তি দেবতা দেন, সেইটেই দুর্লভ। আর, অস্ত্র তাে সামান্য কামারেও দিতে পারে।

 স্বামী হেসে বললেন, কামার তাে অমনি দেয় না, তাকে দাম দিতে হয়।

 সন্দীপ বুক ফুলিয়ে বললেন, দাম দেব গাে দেব।

 স্বামী বললেন, যখন দেবে তখন আমি উৎসবের রােশনচৌকি বায়না দেব।

 সন্দীপ বললেন, তােমার বায়নার আশায় আমরা বসে নেই। আমাদের নিকড়িয়া উৎসব কড়ি দিয়ে কিনতে হবে না।

 ব’লে তিনি তাঁর ভাঙা মােটা গলায় গান ধরলেন—

আমার  নিকড়িয়া রসের রসিক কানন ঘুরে ঘুরে
নিকড়িয়া বাঁশের বাঁশি বাজায় মােহন সুরে।

আমার দিকে চেয়ে হেসে বললেন, মক্ষীরানী, গান যখন প্রাণে আসে তখন গলা না থাকলেও যে বাঁধে না এইটে প্রমাণ করে দেবার জন্যেই গাইলুম। গলার জোরে গাইলে গানের জোর হালকা হয়ে যায়। আমাদের দেশে হঠাৎ ভরপুর গান এসে পড়েছে, এখন নিখিল বসে বসে গােড়া থেকে সারগম সাধতে থাকুক, ইতিমধ্যে আমরা ভাঙা গলায় মাতিয়ে তুলব।

আমার  ঘর বলে, তুই কোথায় যাবি,
বাইরে গিয়ে সব খােওয়াবি।
আমার  প্রাণ বলে, তাের যা আছে সব
যাক-না উড়ে পুড়ে।

আচ্ছা, না হয় আমাদের সর্বনাশই হবে, তার বেশি তাে নয়। রাজি আছি, তাতেই রাজি আছি।

ওগাে,  যায় যদি তাে যাক-না চুকে—
সব হারাব হাসিমুখে,
আমি  এই চলেছি মরণসুধা
নিতে পরাণ পূরে।

আসল কথা হচ্ছে, নিখিল, আমাদের মন ভুলেছে, আমরা সুসাধ্য-সাধনের গণ্ডির মধ্যে টিঁকতে পারব না, আমরা অসাধ্য-সাধনের পথে বেরিয়ে পড়ব।

ওগাে  আপন যারা কাছে টানে
এ রস তারা কেই বা জানে—
আমার  বাঁকা পথের বাঁকা সে যে
ডাক দিয়েছে দূরে।
এবার  বাঁকার টানে সােজার বােঝা
পড়ুক ভেঙেচুরে।

 মনে হল, আমার স্বামীর কিছু বলবার আছে। কিন্তু তিনি বললেন না, আস্তে আস্তে চলে গেলেন।


সমস্ত দেশের উপর এই-যে একটা প্রবল আবেগ হঠাৎ ভেঙে পড়ল ঠিক এই জিনিসটাই আমার জীবনের মধ্যে আর-এক সুর নিয়ে ঢুকেছিল। আমার ভাগ্যদেবতার রথ আসছে, কোথা থেকে তার সেই চাকার শব্দে দিন-রাত্রি আমার বুকের ভিতর গুর্-গুর্ করছে। প্রতি মুহূর্তে মনে হতে লাগল, একটা কী পরমাশ্চর্য এসে পড়ল বলে— তার জন্যে আমি কিছুমাত্র দায়ী নই। পাপ? যে ক্ষেত্রে পাপ-পুণ্য, যে ক্ষেত্রে বিচার-বিবেক, যে ক্ষেত্রে দয়া-মায়া, সে ক্ষেত্র থেকে সম্পূর্ণ সরে যাবার পথ হঠাৎ আপনিই খুলে গেছে। আমি তাে একে কোনােদিন কামনা করি নি, এর জন্যে প্রত্যাশা করে বসে থাকি নি, আমার সমস্ত জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখাে, এর জন্যে আমার তাে কোনাে জবাবদিহি নেই। এতদিন একমাত্র আমি যার পূজা করে এলুম, বর দেবার বেলা এ যে এল আর-এক দেবতা। তাই, সমস্ত দেশ যেমন জেগে উঠে সম্মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠেছে ‘বন্দে মাতরং’ আমার প্রাণ তেমনি করে তার সমস্ত শিরা-উপশিরার কুহরে কুহরে আজ বাজিয়ে তুলেছে, বন্দে— কোন্ অজানাকে, অপূর্বকে, কোন্ সকল-সৃষ্টি-ছাড়াকে!

 দেশের সুরের সঙ্গে আমার জীবনের সুরের অদ্ভুত এই মিল। এক-এক দিন অনেক রাত্রে আস্তে আস্তে আমার বিছানা থেকে উঠে খােলা ছাদের উপর দাঁড়িয়েছি। আমাদের বাগানের পাঁচিল পেরিয়ে আধপাকা ধানের খেত, তার উত্তরে গ্রামের ঘন গাছের ফাঁকের ভিতর দিয়ে নদীর জল এবং তারও পরপারে বনের রেখা, সমস্তই যেন বিরাট রাত্রির গর্ভের মধ্যে কোন্-এক ভাবী সৃষ্টির ভ্রূণের মতাে অস্ফুট আকারে ঘুমিয়ে রয়েছে। আমি সামনের দিকে চেয়ে দেখতে পেয়েছি, আমার দেশ দাঁড়িয়ে আছে আমারই মতাে একটি মেয়ে। সে ছিল আপন আঙিনার কোণে, আজ তাকে হঠাৎ অজানার দিকে ডাক পড়েছে। সে কিছুই ভাববার সময় পেলে না, সে চলেছে সামনের অন্ধকারে; একটা দীপ জ্বেলে নেবারও সবুর তার সয় নি। আমি জানি, এই সুপ্ত রাত্রে তার বুক কেমন করে উঠছে পড়ছে। আমি জানি, যে দূর থেকে বাঁশি ডাকছে ওর সমস্ত মন এমনি করে সেখানে ছুটে গেছে যে ওর মনে হচ্ছে, যেন পেয়েছি, যেন পৌঁচেছি, যেন এখন চোখ বুজে চললেও কোনাে ভয় নেই। না, এ তাে মাতা নয়। সন্তানকে স্তন দিতে হবে, অন্ধকারের প্রদীপ জ্বালাতে হবে, ঘরের ধুলাে ঝাঁট দিতে হবে, সে কথা তাে এর খেয়ালে আসে না। এ আজ অভিসারিকা। এ আমাদের বৈষ্ণব-পদাবলীর দেশ। এ ঘর ছেড়েছে, কাজ ভুলেছে। এর আছে কেবল অন্তহীন আবেগ। সেই আবেগে সে চলেছে মাত্র, কিন্তু পথে কি কোথায় সে কথা তার মনেও নেই। আমিও সেই অন্ধকার রাত্রির অভিসারিকা। আমিও ঘর হারিয়েছি, পথও হারিয়েছি। উপায় এবং লক্ষ্য দুইই আমার কাছে একেবারে ঝাপসা হয়ে গেছে, কেবল আছে আবেগ আর চলা। ওরে নিশাচরী, রাত যখন রাঙা হয়ে পােহাবে তখন ফেরবার পথের যে চিহ্নও দেখতে পাবি নে— কিন্তু ফিরব কেন, মরব। যে কালাে অন্ধকার বাঁশি বাজালাে সে যদি আমার সর্বনাশ করে, কিছুই যদি সে আমার বাকি না রাখে, তবে আর আমার ভাবনা কিসের, সব যাবে, আমার কথাও থাকবে না, চিহ্নও থাকবে না, কালাের মধ্যে আমার সব কালাে একেবারে মিশিয়ে যাবে! তার পরে কোথায় ভালাে কোথায় মন্দ, কোথায় হাসি কোথায় কান্না।

 সেদিন বাংলাদেশের সময়ের কলে পুরাে ইস্‌টিম দেওয়া হয়েছিল। তাই যা সহজে হবার নয় তা দেখতে দেখতে ধাঁ ধাঁ করে হয়ে উঠছিল। বাংলাদেশের যে কোণে আমরা থাকি এখানেও কিছুই আর ঠেকিয়ে রাখা যায় না, এমনি মনে হতে লাগল। এতদিন আমাদের এ দিকে বাংলাদেশের অন্য অংশের চেয়ে বেগ কিছু কম ছিল। তার প্রধান কারণ, আমার স্বামী বাইরের দিক থেকে কারাে উপর কোনাে চাপ দিতে চান না। তিনি বলতেন, দেশের নামে ত্যাগ যারা করবে তারা সাধক; কিন্তু দেশের নামে উপদ্রব যারা করবে তারা শত্রু, তারা স্বাধীনতার গােড়া কেটে স্বাধীনতার আগায় জল দিতে চায়।

 কিন্তু সন্দীপবাবু যখন এখানে এসে বসলেন তাঁর চেলারা চার দিক থেকে আনাগােনা করতে লাগল, মাঝে মাঝে হাটে বাজারে বক্তৃতাও হতে থাকল— তখন এখানেও ঢেউ উঠতে লাগল। একদল স্থানীয় যুবক সন্দীপের সঙ্গে জুটে গেল। তাদের মধ্যে এমন অনেকে ছিল যারা গ্রামের কলঙ্ক। উৎসাহের দীপ্তির দ্বারা তারাও ভিতরে বাহিরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এটা বেশ বােঝা গেল, দেশের হাওয়ার মধ্যে যখন আনন্দ বইতে থাকে তখন মানুষের বিকৃতি আপনি সেরে যায়। মানুষের পক্ষে সুস্থ সবল হওয়া বড়াে কঠিন যখন দেশে আনন্দ না থাকে।

 এই সময় সকলের চোখে পড়ল আমার স্বামীর এলাকা থেকে বিলিতি নুন, বিলিতি চিনি, বিলিতি কাপড় এখনাে নির্বাসিত হয় নি। এমন-কি, আমার স্বামীর আমলারা পর্যন্ত এই নিয়ে চঞ্চল এবং লজ্জিত হয়ে উঠতে লাগল। অথচ কিছুদিন পূর্বে আমার স্বামী যখন এখানে স্বদেশী জিনিসের আমদানি করেছিলেন তখন এখানকার ছেলেবুড়াে সকলেই তা নিয়ে মনে মনে এবং প্রকাশ্যে হাসাহাসি করেছিল। দিশি জিনিসের সঙ্গে যখন আমাদের স্পর্ধার যােগ ছিল না তখন তাকে আমরা মনে প্রাণে অবজ্ঞা করেছি। এখনাে আমার স্বামী তাঁর সেই দিশি ছুরিতে দিশি পেনসিল কাটেন, খাগড়ার কলমে লেখেন, পিতলের ঘটিতে জল খান এবং সন্ধ্যার সময়ে শামাদানে দিশি বাতি জ্বালিয়ে লেখাপড়া করেন। কিন্তু তাঁর এই অত্যন্ত সাদা ফিকে রঙের স্বদেশীতে আমার মনের মধ্যে কোনাে রস পাই নি। বরঞ্চ তখন তাঁর বসবার ঘরে আসবাবের দৈন্যে আমি লজ্জা বােধ করে এসেছি, বিশেষত বাড়িতে যখন ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা আর-কোনাে সাহেব-সুবাের সমাগম হত। আমার স্বামী হেসে বলতেন, এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুমি অত বিচলিত হচ্ছ কেন?

 আমি বলতুম, ওরা যে আমাদের অসভ্য অজবুগ মনে করে যাবে।

 তিনি বলতেন, তা যখন মনে করবে তখন আমিও এই কথা মনে করব, ওদের সভ্যতা চামড়ার উপরকার সাদা পালিশ পর্যন্ত, বিশ্বমানুষের ভিতরকার লাল রক্তধারা পর্যন্ত পৌঁছয় নি।

 ওঁর ডেস্কে একটি সামান্য পিতলের ঘটিকে উনি ফুলদানি করে ব্যবহার করতেন। কতদিন কোনাে সাহেব আসবার খবর পেলে আমি লুকিয়ে সেটিকে সরিয়ে বিলিতি রঙিন কাচের ফুলদানিতে ফুল সাজিয়ে রেখেছি।

 আমার স্বামী বলতেন, দেখাে বিমল, ফুলগুলি যেমন আত্মবিস্মৃত আমার এই পিতলের ঘটিটিও তেমনি। কিন্তু তােমার ঐ বিলিতি ফুলদানি অত্যন্ত বেশি করে জানায় যে ও ফুলদানি। ওতে গাছের ফুল না রেখে পশমের ফুল রাখা উচিত।

 তখন এ সম্বন্ধে তাঁর একমাত্র উৎসাহদাতা ছিলেন মেজোরানী। তিনি একেবারে হাঁপিয়ে এসে বলতেন, ঠাকুরপাে, শুনেছি আজকাল দিশি সাবান উঠেছে নাকি। আমাদের তাে ভাই, সাবান মাখার দিন উঠেই গেছে, তবে ওতে যদি চর্বি না থাকে তা হলে মাখতে পারি। তােমাদের বাড়িতে এসে অবধি ঐ এক অভ্যেস হয়ে গেছে। অনেক দিন তাে ছেড়েই দিয়েছি, তবু সাবান না মেখে আজও মনে হয় যেন স্নানটা ঠিকমত হল না।

 এতেই আমার স্বামী ভারি খুশি। বাক্স বাক্স দিশি সাবান আসতে লাগল। সে কি সাবান না সাজিমাটির ডেলা! আমি বুঝি জানি নে? স্বামীর আমলে মেজোরানী যে বিলিতি সাবান মাখতেন আজও সমানে তাই চলেছে; একদিনও কামাই নেই। ঐ দিশি সাবান দিয়ে তাঁর কাপড়কাচা চলতে লাগল।

 আর-একদিন এসে বললেন, ভাই ঠাকুরপাে, দিশি কলম নাকি উঠেছে? সে তাে আমার চাই। মাথা খাও, আমাকে এক বাণ্ডিল—

 ঠাকুরপাে মহা উৎসাহিত। কলমের নাম ধরে যত রকমের দাঁতনের কাঠি তখন বেরিয়েছিল সব মেজোরানীর ঘরে বােঝাই হতে লাগল। ওতে ওঁর কোনাে অসুবিধে ছিল না, কেননা লেখাপড়ার সম্পর্ক ওঁর ছিল না বললেই হয়। ধােবার বাড়ির হিসেব শজনের ডাঁটা দিয়ে লেখাও চলে। তাও দেখেছি, লেখার বাক্সের মধ্যে ওঁর সেই পুরনাে কালের হাতির দাঁতের কলমটি আছে, যখন কালেভদ্রে লেখার শখ যায় তখন ঠিক সেইটেরই উপর হাত পড়ে।

 আসল কথা, আমি যে আমার স্বামীর খেয়ালে যােগ দিই নে সেইটের কেবল জবাব দেবার জন্যেই উনি এই কাণ্ডটি করতেন। অথচ আমার স্বামীকে ওঁর এই ছলনার কথা বলবার জো ছিল না। বলতে গেলেই তিনি এমন মুখ করে চুপ করে থাকতেন যে, বুঝতুম যে উলটো ফল হল। এ-সব মানুষকে ঠকানাের হাত থেকে বাঁচাতে গেলেই ঠকতে হয়।

 মেজোরানী সেলাই ভালােবাসেন; একদিন যখন সেলাই করছেন তখন আমি স্পষ্টই তাঁকে বললুম, এ তােমার কী কাণ্ড! এ দিকে তােমার ঠাকুরপাের সামনে দিশি কাঁচির নাম করতেই তােমার জিব দিয়ে জল পড়ে, ও দিকে সেলাই করবার বেলা বিলিতি কাঁচি ছাড়া যে তােমার এক দণ্ড চলে না!

 মেজোরানী বললেন, তাতে দোষ হয়েছে কী? কত খুশি হয় বল দেখি। ছোটোবেলা থেকে ওর সঙ্গে যে একসঙ্গে বেড়েছি, তােদের মতাে ওকে আমি হাসিমুখে কষ্ট দিতে পারি নে। পুরুষমানুষ, ওর আর তাে কোনাে নেশা নেই— এক, এই দিশি দোকান নিয়ে খেলা, আর ওর এক সর্বনেশে নেশা তুই— এইখেনেই ও মজবে!

 আমি বললুম, যাই বল, পেটে এক মুখে এক ভালাে নয়।

 মেজোরানী হেসে উঠলেন; বললেন, ওলাে সরলা, তুই যে দেখি বড় বেশি সিধে, একেবারে গুরুমশায়ের বেতকাঠির মতাে! মেয়েমানুষ অত সােজা নয়— সে নরম বলেই অমন একটু-আধটু নুয়ে থাকে, তাতে দোষ নেই।

 মেজোরানীর সেই কথাটি ভুলব না, ওর এক সর্বনেশে নেশা তুই, এইখেনেই ও মজবে।

 আজ আমার কেবলই মনে হয়, পুরুষমানুষের একটা নেশা চাই, কিন্তু সে নেশা যেন মেয়েমানুষ না হয়।

আমাদের শুকসায়রের হাট এ জেলার মধ্যে মস্ত বড়াে হাট। এখানে জোলার এ ধারে নিত্য বাজার বসে, আর জোলার ও ধারে প্রতি শনিবারে হাট লাগে। বর্ষার পর থেকেই এই হাট বেশি করে জমে। তখন নদীর সঙ্গে জোলার যােগ হয়ে যাতায়াতের পথ সহজ হয়ে যায়। তখন সুতাে এবং আগামী শীতের জন্যে গরম কাপড়ের আমদানি খুব বেড়ে ওঠে।

 সেই সময়টাতে দিশি কাপড় আর দিশি নুন-চিনির বিরােধ নিয়ে বাংলাদেশের হাটে হাটে তুমুল গণ্ডগােল বেধেছে। আমাদের সকলেরই খুব একটা জেদ চড়ে গেছে। আমাকে সন্দীপ এসে বললেন, এত বড়াে হাট-বাজার আমাদের হাতে আছে, এইটাকে আগাগােড়া স্বদেশী করে তুলতে হবে। এই এলাকা থেকে বিলিতি অলক্ষ্মীকে কুলাের হাওয়া দিয়ে বিদায় করা চাই।

 আমি কোমর বেঁধে বললুম, চাই বৈকি।

 সন্দীপ বললেন, এ নিয়ে নিখিলের সঙ্গে আমার অনেক কথা-কাটাকাটি হয়ে গেছে, কিছুতে পেরে উঠলুম না। ও বলে, বক্তৃতা পর্যন্ত চলবে, কিন্তু জবরদস্তি চলবে না।

 আমি একটু অহংকার করে বললুম, আচ্ছা, সে আমি দেখছি।

 আমি জানি, আমার উপর আমার স্বামীর ভালােবাসা কত গভীর। সেদিন আমার বুদ্ধি যদি স্থির থাকত তা হলে আমার পােড়া মুখ নিয়ে এমন দিনে সেই ভালােবাসার উপর দাবি করতে যেতে আমার লজ্জায় মাথা কাটা যেত। কিন্তু সন্দীপকে যে দেখাতে হবে আমার শক্তি কত। তাঁর কাছে আমি যে শক্তিরূপিণী। তিনি তাঁর আশ্চর্য ব্যাখ্যার দ্বারা বার বার আমাকে এই কথাই বুঝিয়েছেন যে, পরমাশক্তি এক-একজন বিশেষ মানুষের কাছে এক-একজন বিশেষ মানুষেরই রূপে দেখা দেন। তিনি বলেন, আমরা বৈষ্ণবতত্ত্বের হ্লাদিনীশক্তিকে প্রত্যক্ষ দেখবার জন্যেই এত ব্যাকুল হয়ে বেড়াচ্ছি; যখন কোথাও দেখতে পাই তখনই স্পষ্ট বুঝতে পারি, আমার অন্তরের মধ্যে যে ত্রিভঙ্গ বাঁশি বাজাচ্ছেন তার বাঁশির অর্থটা কী। বলতে-বলতে এক-এক দিন তিনি গান ধরতেন—

যখন দেখা দাও নি রাধা তখন বেজেছিল  বাঁশি
এখন চোখে চোখে চেয়ে  সুর যে আমার গেল ভাসি।
তখন নানা তানের ছলে
ডাক ফিরেছে জলে স্থলে,
এখন আমার সকল কাঁদা রাধার রূপে উঠল হাসি।

 এই-সব কেবলই শুনতে শুনতে আমি ভুলে গিয়েছিলুম যে আমি বিমলা। আমি শক্তিতত্ত্ব, আমি রসতত্ত্ব, আমার কোনাে বন্ধন নেই, আমার মধ্যে সমস্তই সম্ভব, আমি যা-কিছুকে স্পর্শ করছি তাকেই নূতন করে সৃষ্টি করছি। নূতন করে সৃষ্টি করছি আমার এই জগৎকে; আমার হৃদয়ের পরশমণি ছোঁওয়াবার আগে শরতের আকাশে এত সােনা ছিল না; আর, মুহূর্তে মুহূর্তে আমি নূতন করছি ঐ বীরকে, ঐ সাধককে, ঐ আমার ভক্তকে— ঐ জ্ঞানে উজ্জ্বল, তেজে উদ্দীপ্ত ভাবের রসে অভিষিক্ত অপূর্ব প্রতিভাকে। আমি যে স্পষ্ট অনুভব করছি, ওর মধ্যে প্রতি ক্ষণে আমি নূতন প্রাণ ঢেলে দিচ্ছি, ও আমার নিজেরই সৃষ্টি। সেদিন অনেক অনুরােধ করে সন্দীপ তাঁর একটি বিশেষ ভক্ত বালক অমূল্যচরণকে আমার কাছে এনেছিলেন। এক দণ্ড পরেই আমি দেখতে পেলুম, তার চোখের তারার মধ্যে একটা নূতন দীপ্তি জ্বলে উঠল। বুঝলুম, সে আদ্যাশক্তিকে দেখতে পেয়েছে। বুঝতে পারলুম, তার রক্তের মধ্যে আমারই সৃষ্টির কাজ আরম্ভ হয়েছে। পরদিন সন্দীপ আমাকে এসে বললেন, এ কী মন্ত্র তােমার! ও বালক তাে আর সেই বালক নেই, ওর পলতেয় এক মুহূর্তে শিখা ধরে গেছে। তােমার এ আগুনকে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখবে কে! একে একে সবাই আসবে। একটি একটি করে প্রদীপ জ্বলতে জ্বলতে একদিন যে দেশে দেয়ালির উৎসব লাগবে।

 নিজের এই মহিমার নেশায় মাতাল হয়েই আমি মনে মনে ঠিক করেছিলুম ভক্তকে আমি বরদান করব। আর, এও আমার মনে ছিল, আমি যা চাইব তাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।

 সেদিন সন্দীপের কাছ থেকে ফিরে এসেই চুল খুলে ফেলে আমি নতুন করে চুল বাঁধলুম। ঘাড়ের থেকে এঁটে চুলগুলােকে মাথার উপরের দিকে টেনে তুলে আমার মেম আমাকে এক রকম খোঁপা বাঁধতে শিখিয়েছিলেন; আমার স্বামী আমার সেই খোঁপা খুব ভালােবাসতেন। তিনি বলতেন, ঘাড় জিনিসটা যে কত সুন্দর হতে পারে তা বিধাতা কালিদাসের কাছে প্রকাশ না করে আমার মতাে অ-কবির কাছে খুলে দেখালেন। কবি হয়তাে বলতেন পদ্মের মৃণাল, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় যেন মশাল; তার ঊর্ধ্বে তােমার কালাে খোঁপার কালাে শিখা উপরের দিকে জ্বলে উঠেছে। এই বলে তিনি আমার সেই চুল-তােলা ঘাড়ের উপর— হায় রে, সে কথা আর কেন!

 তার পর তাঁকে ডেকে পাঠালুম। আগে এমন ছােটোখাটো সত্যমিথ্যা নানা ছুতােয় তাঁর ডাক পড়ত। কিছুদিন থেকে ডাকবার সব উপলক্ষই বন্ধ হয়ে গেছে, বানাবার শক্তিও নেই।