পাতা:বিভূতি রচনাবলী (একাদশ খণ্ড).djvu/১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ফিল্ম-স্টারদের দেহভোগের অধিকারী হতে পেরেছিল। অন্যদিকে দেখি ‘অথৈজলে'র নায়ক শশাঙ্ক সেই খেমটাউলী কিশোরী পান্নার প্রেমে উন্মাদ হয়ে সর্বস্ব ত্যাগ করেছে। কিন্তু তাকে পাবার জন্যে সে টাকাপয়সা খরচ করে নি, বরং পান্নাই নিজের যা-কিছু উপার্জন সব দিয়ে শশাঙ্ককে ধরে রাখতে চেয়েছে। সে কোনদিন চায় নি যে শশাঙ্ক আলাদা রোজগার ক'রে টাকা এনে তাকে খাওয়াক-পরাক । বরং শশাঙ্কর সব ভার নিজে বহন করাতে দুঃখের চেয়ে স্বথ পেয়েছে বেশী । অথচ কেন শশাঙ্কর মত এক প্রৌঢ়ের জন্যে পান্না এই কষ্ট স্বীকার করতে গেল ? বড় বড় ধনী, জমিদাররা পর্যন্ত তাকে অনেক প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের জীবনসঙ্গিনী করতে চেয়েছিল। এক জমিদারের ছেলে ওর পেছনে অনেক টাকা খরচ করেও পায়াকে পায় নি, ও তাকে দূর করে দিয়েছিল। এই কথাটা যেদিন পান্নার দলের নীলিমা শশাঙ্ককে আড়ালে ডেকে বলতে গিয়ে, একটু থেমে আবার বলেছিল, তাই বলি আপনার ক্ষমতা আছে”—তখন শশাঙ্ক অভিভূত হয়ে পড়েছিল—“জীবনের এসব অতি বড় অনুভূতি, আমি নিজে আস্বাদ করে বুঝেছি। মন এবং মনের বস্তু ! টাকা না কড়ি না, বিষয়-আশয় না —এমন কি যশমানের আকাঙ্ক্ষা পর্যন্ত না । ওসব ছেড়েছুড়ে দিয়ে, নিজের সকল প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে পাল্লাকে নিয়ে অকুলে ভেসেছি। ভেসে আজ বুঝতে পেরেছি, ত্যাগ না করলে বস্তলাভ হয় না। আমার অনুভূতিকে বুঝতে হলে, আমার মত অবস্থায় এসে পড়তে হবে।” ত্যাগ না করলে বস্তলাভ হয় না, শশাঙ্ক নিজেই ওই কথাটি স্বীকার করেছে। এখানে প্রশ্ন, এই বস্তুটা কি ? নিশ্চয়ই দেহ নয় ! দেহকে বাদ দিয়ে যে মন—যা দেহাতীত, অনুভূতিসাপেক্ষ—কেবলমাত্র অনুভূতির দ্বারাই পাওয়া যায়, লাভ করা যায়। রূপ ছেড়ে সেই রূপাতীত বস্তু দুর্লভরত্ব কিশোরী প্রেমকেই তিনি পেতে চেয়েছিলেন। এবং তার জন্যেই সর্বত্যাগী ভিখারী হয়েছেন । 鬱 এই উপন্যাস ‘অথৈজল'কে তাই নেহাৎই এক পদস্থলনের কাহিনী বললে ভুল করা হবে । এখানে তিনি দেহবাদ নিয়ে গভীর তত্ত্বকথা আলোচনা করেছেন। বিভূতিভূষণ সাতার বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। ‘অথৈজল’ তার মৃত্যুর তিন বৎসর পূর্বে রচিত। পান্না ও শশাঙ্কর প্রেম আধ্যাত্মিক প্রেমের প্রতীক। দেহবাদের অতীত যে পরম প্রেম তাকেই যেন শশাঙ্ক পেতে চেয়েছে বলে মনে হয় । রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—“ধন নয় মান নয়, কিছু ভালোবাসা, করেছিক্স আশা ।” তাই দম্পতি’র নায়কের পদস্খলন ও “অথৈজলে’র নায়কের পদস্থলন এক পর্যায়ে পড়ে না । গদাধর যেমন লাভের প্রয়াসী, পয়সার বিনিময়ে নারীকে ভোগ করতে চেয়েছে ; শশাঙ্ক তেমনি ত্যাগের মধ্যে দিয়ে দেহাতীত প্রেমকে পেতে চেয়েছে। গদাধর যদি দেহবাদীর প্রতীক, শশাঙ্ক সেই দেহাতীত অধ্যাত্মিক প্রেমের প্রতীক ;– "নিত্য থেকে লীলায় নেমে দেখি না, ব্যাপারটা কিরকম দেখায়।” এ প্রেম সেই লীলার