পাতা:বিভূতি রচনাবলী (একাদশ খণ্ড).djvu/৩১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জ্যোতিরিঙ্গণ R3) এবার রোদপোড়া মাঠে চৈত্র দুপুরে আমি আর গ্রামের দুটি ছেলে মাছ ধরছি, হঠাৎ একটি ছেলে—তার নাম হরু, রামচন্দ্র সাবুই এর ছেলে, আজও মনে আছে—আঙল দিয়ে দেখিয়ে বললে—ও কে—ওই দ্যাখ— —কে রে ? কই, কোথায় ? —ওই তো বসে । তার পর সবাই মিলে কাছে গিয়ে দেখলাম তালগাছের তলায় এক সাহেব বসে ; তার পরনে অতি জীর্ণ ও মলিন তালি দেওয়া প্যান্টালুন, তেমনি কোট, তেমনি জুতো । আমরা কাছে যেতে সাহেব কি-একটা বললে, আমরা বুঝতে পারলাম না। যে সময়ের কথা বলছি, তখন একজন সাহেবকে এ অবস্থায় অজ পল্লীগ্রামে দেখা খুব একটা আশ্চর্য্য বিষয় ছিল । আমরা সবাই মুখ-চাওয়াচাওয়ি করছি, এমন সময় সাহেবট আবার কি যেন বললে । হরু বললে, ও খেতে চাইছে ভাই । আমারও তাই মনে হল । আমি হাত দিয়ে দেখিয়ে বললাম~—আমার সঙ্গে এস। সেই সাহেবকে নিয়ে আমাদের বাড়ী এলাম । বাবা অবাক হয়ে এগিয়ে এলেন । তিনি মাইনর স্কুলের সেকেন মাস্টার । আমাদের বাড়ীতে দু তিনটে ধানের গোলা ছিল, চল্লিশ বিঘে ধানের জমি ছিল, পুকুরে মাছ ছিল, জিনিসপত্রও তখন সস্তা ছিল । সংসার ভালই চলত, মোটা ভাত-কাপড়ের অভাব ছিল না। বাবা সাহেবকে বাইরের ঘরে একটা টুলের ওপর বসলেন । চেয়ার ছিল না আমাদের বাড়ী । ইংরেজিতে কি কথা তার সঙ্গে বললেন । তার পর আমাকে বললেন, বাড়ীর মধ্যে যা, তোর দিদিকে গিয়ে বল গে এক বাটি মুড়ি আর দুধ পাঠিয়ে দিতে। সাহেব খাবে। আমি কিছু আশ্চৰ্য্য হয়েই দিদিকে গিয়ে কথাটা বললাম। আমার মা এ সময় খুব পীড়িত, আমার ছোট ভাই বিনয় তখন সবে মাস-থানেক হল জন্মেছে, মার শরীর সেই থেকেই খারাপ ! দিদি কাসার বড় জামবাটিতে মুড়ি দুধ আর তালের গুড় একসঙ্গে মেখে আমার হাতে দিয়ে বললে, কেমন সাহেব রে ? —ভাল সাহেব | e —চল আড়ালে দাড়িয়ে দেখে আসি । আমার দিদির নাম ছিল বীণা, আমার সে দিদি মারা গিয়েছে বহুদিন । বাবার মুখে সব শুনলাম। সাহেব আসছে বরাকর থেকে, গরিব, ওর কেউ কোথাও নেই। বাবার কাছে আশ্রয় চেয়েছে ; বাবা বলছেন, থাক। তবে আমাদের ঘরে যা জোটে তাই খেতে হবে । সাহেব তাতেই রাজী হয়েছে। সেই থেকে সাহেব আমাদের বাড়ীই রয়ে গেল। গায়ের লোক দলে দলে আসতে লাগল সাহেবকে দেখতে ।