পাতা:বিভূতি রচনাবলী (একাদশ খণ্ড).djvu/৪৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

80%r বিভূতি-রচনাবলী —আসলে তোমরা আমাদের তুলনায় কিছুই নয় । এই ঘোষণা করবার আর্টটা ছিল ওদের চমৎকার। বিদেশে যারা অবস্থাপন্ন হয়ে বাস করে, তারা নিজেদের গ্রামে এসে নিজেদের বড়ত্ব প্রচার করবার যে সাধারণ প্রণালী অবলম্বন করে, সেটা হচ্ছে পূজোর সময় বাড়ী এসে ধুমধামে দুর্গোৎসব করা। কিংবা একটা পুকুর কাটা । কিংবা দুটোই একসঙ্গে । 鬱 এদের প্রণালী ছিল আরো সূক্ষ্ম । তত ব্যয়সাধ্য নয়, অথচ আবেদনের গুরুত্বে সফলতর । 尊 স্টেশনে নেমে এরা দু’খানা ঘোড়ার গাড়ী ভাড়া করে বাড়ী আসতে, সঙ্গে থাকতো দুটি চাকর, একটা ঠাকুর, একটা ঝি। দামী বিছানাপত্রের মোট ঘোড়ার গাড়ীর ছাদে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। ঠাকুর-চাকরেরা বসে থাকতে ছাদে কোচম্যানের সঙ্গে। ওদের পরনে থাকতে ধপধপে ফর্স কাপড়। একটা ঝুড়িতে নানারকমের ফল বোঝাই থাকতো। গাড়ী থেকে জিনিসপত্র নামাবার সময় নিবারণ হেঁকে বলতো—ওরে, ফলের ঝুড়িটা সাবধানে নামা । রাচির পেপেগুলো যেন নষ্ট না হয়ে যায়—আনারস ক'টা দেখেশুনে নাম— চারিপাশে ইতিমধ্যে গায়ের ছেলেপিলেরা ততক্ষণ ভিড় করত। দু-একজন পথ-চলতি লোকও ই করে তাকিয়ে দেখতে ভিড়ের মধ্যে থেকে । তাদের মধ্যে হয়তো কেউ বলতো–কর্মকারমশাই বাড়ী আলেন ? - হয়তো সাতকড়ি বলতো–তা তো এলাম। কি যে কষ্ট, কলকাতা থেকে জিনিসপত্তর নিয়ে আসা, তবু তো সেকেও ক্লাশ রিজার্ভ করে এলাম। তাও মধুপুরের কুঁজোট নামাতে গিয়ে ভেঙে গেল—ও ঠাকুর, এই বাক্সটা ধরে নামাও, র্কাচের বাসন আছে— এ প্রণালীর আবেদন সূক্ষ্মতর, কিন্তু আদৌ ব্যয়সাধ্য নয়। আমরা যে যার বাড়ী এসে ঘটা করে বর্ণনা করতাম আমাদের গরিব বাপ-মায়ের কাছে ওদের এই ঐশ্বৰ্য্যবহুল সাড়ম্বর গৃহ-প্রবেশ । লোকের মুখে মুখে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়তো । তারপর ওরা যতদিন থাকতো,প্রতিদিনে নানা ঘটনায় ওরা বুঝিয়ে দিত ওদের সঙ্গে এ গ্রামের লোকের তফাৎ কতখানি । সাতকড়ি ছিল বড় ভাই, নিবারণ ছোট । নিবারণের ছেলে ছিল মাত্র একটি, তার নাম সতীশ । তখন তার বয়েস উনিশ-কুড়ি ; পড়াশুনো কতদূর করেছিল জানি নে, বাবা ও জ্যাঠামশাইয়ের ব্যবসায়ে শিক্ষানবিসি করতে সে সময় । সাতকড়ি ছিল নিঃসস্তান । দুই বড়লোক ভায়ের এই এক ছেলে, তার কাপড় জমা জুতো যে ধরনের ছিল আমরা তেমন কখনো চক্ষেও দেখি নি । হয়তো আমরা তাকে ঘিরে হা করে ওদের বাড়ীর সামনে পথে দাড়িয়ে কলকাতার গল্প শুনচি, ওর জ্যাঠামশায় হেঁকে ডাক দিলে—ও সতে, লুচি জুড়িয়ে গেল যে, ঠাকুর কতক্ষণ বসে থাকবে তোমার খাবার নিয়ে—সকলের খাওয়া হয়ে গেল, তোমার কেবল গল্প— আমাদের গ্রামের অনেকে ওদের বৈঠকখানায় গিয়ে বলতেন ওরা বাড়ী এলে।