ভারতবর্ষ/ভারতবর্ষের ইতিহাস

উইকিসংকলন থেকে
ভারতবর্ষের ইতিহাস।

 আমাদের দেশে রাজা ছিলেন সমাজের একটি অঙ্গ। ব্রাহ্মণ গুরুগণও একভাবে সমাজরক্ষা-ধর্ম্মরক্ষায় প্রবৃত্ত ছিলেন, ক্ষত্রিয় রাজারাও অন্যভাবে সেই কার্যেই ব্রতী ছিলেন। দেশরক্ষা গৌণ, কিন্তু দেশের ধর্মরক্ষাই তাঁহাদের মুখ্য কর্তব্য ছিল। ভারতবর্ষে সাধারণত রাজা সমস্ত দেশকে গ্রাস করেন নাই। তাঁহারা প্রধান ব্যক্তি ছিলেন সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহাদের স্থান সীমাবদ্ধ, নির্দিষ্ট ছিল। সেইজন্য রাজার অভাবে ভারতীয় সমাজ অঙ্গহীন হইত, দুর্বল হইত, তবু মরিত না। যেমন এক চক্ষুর অভাবে অন্য চক্ষু দিয়া দৃষ্টি চলে,তেমনি স্বদেশী রাজার অভাবেও সমাজের কাজ চলিয়া গেছে।

 বিদেশী রাজা আর সমস্ত অধিকার করিতে পারে, কিন্তু সামাজিক সিংহাসনের অংশ গ্রহণ করিতে পারে না। সমাজই ভারতবর্ষের মর্ম্মস্থান; সেই সমাজের সহিত বিদেশী রাজার নাড়ীর সম্বন্ধ না থাকাতে যথার্থ ভারতবর্ষের সহিত তাহার সম্বন্ধ অত্যন্ত ক্ষীণ।

 সকল দেশেই বিদেশী রাজা দেশের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে পারে না—ভারতবর্ষে আরো বেশি। কারণ, ভারতবর্ষীয় সমাজ দুর্গের ন্যায় দৃঢ় প্রাকাম্বের দ্বারা আপনাকে দুর্গম করিয়া রাখিয়াছে। বিদেশী অনাত্মীয় তাহার মধ্যে অবারিত পথ পায় না। এইজন্য বিদেশী সাম্রাজ্যের ইতিহাস ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস নহে। ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় ইতিবৃত্ত ভারত-ইতিবৃত্তের অতি সামান্য অংশ—তাহা পরিশিষ্টভাগে লিখিত হইবার যোগ্য।  ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই, তাহা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্নকাহিনীমাত্র। কোথা হইতে কাহারা আসিল, কাটাকাটি-মারামারি পড়িয়া গেল, বাপে-ছেলেয় ভাইয়ে-ভাইয়ে সিংহাসন লইয়া টানাটানি চলিতে লাগিল, এক দল যদি বা যায়, কোথা হইতে আর-এক দল উঠিয়া পড়ে–পাঠান-মোগল, পর্ত্তুগীজ-ফরাসী-ইংরাজ, সকলে মিলিয়া এই স্বপ্নকে উত্তরোত্তর জটিল করিয়া তুলিয়াছে।

 কিন্তু এই রক্তবর্ণে রঞ্জিত পরিবর্ত্তমান স্বপ্নদৃশ্যপটের দ্বারা ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করিয়া দেখিলে, যথার্থ ভারতবর্ষকে দেখা হয় না। ভারতবাসী কোথায়—এ সকল ইতিহাস তাহার কোন উত্তর দেয় না। যেন ভারতবাসী নাই—কেবল যাহারা কাটাকাটি-খুনাখুনি করিয়াছে, তাহারাই আছে।

 তখনকার দুর্দিনেও এই কাটাকাটি-খুনাখুনিই যে ভারতবর্ষের প্রধানতম ব্যাপার, তাহা নহে। ঝড়ের দিনে যে ঝড়ই সর্ব প্রধান ঘটনা, তাহা তাহার গর্জনসত্বেও স্বীকার করা যায় না,–সে দিনও সেই ধূলিসমাচ্ছন্ন আকাশের মধ্যে পল্লীর গৃহে গৃহে যে জন্ম-মৃত্যু-সুখদুঃখের প্রবাহ চলিতে থাকে, তাহা ঢাকা পড়িলেও মানুষের পক্ষে তাহাই প্রধান। কিন্তু বিদেশী পথিকের কাছে এই ঝড়টাই প্রধান, এই ধূলিজালই তাহার চক্ষে আর সমস্তই গ্রাস করে; কারণ, সে ঘরের ভিতরে নাই, সে ঘরের বাহিরে। সেইজন্য বিদেশীর ইতিহাসে এই ধূলির কথা–ঝড়ের কথাই পাই, ঘরের কথা কিছুমাত্র পাই না। সেই ইতিহাস পড়িলে মনে হয়, ভারতবর্ষ তখন ছিল না, কেবল মোগল-পাঠানের গর্জনমুখর বাত্যাবর্ত শুষ্কপত্রের ধ্বজা তুলিয়া উত্তর ইতে দক্ষিণে এবং পশ্চিম হইতে পূর্বে ঘুরিয়া-ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল।

 কিন্তু বিদেশ যখন ছিল, দেশ তখনো ছিল, নহিলে এই সমস্ত উপদ্রবের মধ্যে কবীর, নানক, চৈতন্য, তুকারাম, ইহাদিগকে জন্ম দিল কে? তখন যে কেবল দিল্লী এবং আগ্রা ছিল, তাহা নহে— কাশী এবং নবদ্বীপও ছিল। তখন প্রকৃত ভারতবর্ষের মধ্যে যে জীবনস্রোত বহিতেছিল, যে চেষ্টার তরঙ্গ উঠিতেছিল, যে সামাজিক পরিবর্তন ঘটিতেছিল, তাহার বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না।

 কিন্তু বর্তমান পাঠ্যগ্রন্থের বহিভূত, সেই ভারতবর্ষের সঙ্গেই আমাদের যোগ। সেই যোগের বহুবর্ষকালব্যাপী ঐতিহাসিক সূত্র বিলুপ্ত হইয়া গেলে আমাদের হৃদয় আশ্রয় পায় না। আমরা ভারতবর্ষের আগাছা-পরগাছা নহি—বহুশত শতাব্দীর মধ্য দিয়া আমাদের শতসহস্র শিকড় ভারতবর্ষের মর্ম্মস্থান অধিকার করিয়া আছে। কিন্তু দুরদৃষ্টক্রমে এমন ইতিহাস আমাদিগকে পড়িতে হয় যে, ঠিক সেই কথাটাই আমাদের ছেলেরা ভুলিয়া যায়। মনে হয়, ভারতবর্ষের মধ্যে আমরা যেন কেহই না, আগন্তুক বর্গই যেন সব।

 নিজের দেশের সঙ্গে নিজের সম্বন্ধ এইরূপ অকিঞ্চিৎকর বলিয়া আনিলে, কোথা হইতে আমরা প্রাণ আকর্ষণ করিব? এরূপ অবস্থায় বিদেশকে স্বদেশের স্থানে বসাইতে আমাদের মনে দ্বিধা হয় না–ভারতবর্ষের অগৌরবে আমাদের প্রাণান্তকর লজ্জাবোধ হইতে পারে। আমরা অনায়াসেই বলিয়া থাকি, পূর্বে আমাদের কিছুই ছিল, এবং এখন আমাদিগকে অশনবসন, আচারব্যবহার, সমস্তই বিদেশীর কাছ হইতে ভিক্ষা করিয়া লইতে হইবে।

 যে সকল দেশ ভাগ্যবান, তাহারা চিরন্তন স্বদেশকে দেশের ইতিহাসের মধ্যেই খুঁজিয়া পায়–বালককালে ইতিহাসই দেশের সহিত তাহাদের পচিয়সাধন করাইয়া দেয়। আমাদের ঠিক তাহার উল্টা। দেশের ইতিহাসই আমাদের স্বদেশকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। মামুদের আক্রমণ হইতে লর্ড কার্জনের সাম্রাজ্যগর্বোদগারকাল পর্য্যন্ত যে কিছু ইতিহাসকথা, তাহা ভারতবর্ষের পক্ষে বিচিত্র কুহেলিকা—তাহা স্বদেশসম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টির সহায়তা করে না, দৃষ্টি আবৃত করে মাত্র। তাহা এমন স্থানে কৃত্রিম আলোক ফেলে, যাহাতে আমাদের দেশের দিকটাই আমাদের চোখে অন্ধকার হইয়া যায়। সেই অন্ধকারের মধ্যে নবাবের বিলাসশালার দীপালোকে নর্ত্তকীর মণিভূষণ জলিয়া উঠে; বাদ্সাহের সুরাপাত্রের রক্তিম ফেনোচ্ছাস উন্মত্ততার জাগররক্ত দীপ্ত-নেত্রের ন্যায় দেখা দেয়—সেই অন্ধকারে আমাদের প্রাচীন দেবমন্দিরসকল মস্তক আবৃত করে এবং সুলতান-প্রেয়সীদের শ্বেতমর্ম্মরচিত কারুখচিত কবরচুড়া নক্ষত্রলোক চুম্বন করিতে উদ্যত হয়। সেই অন্ধকারের মধ্যে অশ্বের খুরধ্বনি, হস্তীর বৃংহিত, অস্ত্রের ঝঞনা, সুদুরব্যাপী শিবিরের তরঙ্গিত পাণ্ডুরতা, কিংখাব-আস্তরণের স্বর্ণচ্ছটা, মসজিদের ফেনবুদবুদাকার পাষাণমণ্ডপ, খোজাপ্রহরীরক্ষিত প্রাসাদ-অন্তঃপুরে রহস্যনিকেতনের নিস্তব্ধ মৌন—এ সমস্তই বিচিত্র শব্দে ও বর্ণে ও ভাবে যে প্রকাণ্ড ইন্দ্রজাল রচনা করে, তাহাকে ভারতবর্ষের ইতিহাস বলিয়া লাভ কি? তাহা ভারতবর্ষের পুণ্যমন্ত্রের পুঁথিটিকে একটি অপরূপ আরব্য উপন্যাস দিয়া মুড়িয়া রাখিয়াছে—সেই পুথিখানি কেহ খোল না, সেই আরব্য উপন্যাসেরই প্রত্যেক ছাত্র ছেলেরা মুখস্থ করিয়া লয়। তাহার পরে প্রলয়রাত্রে এই মোগল সাম্রাজ্য যখন মুমূর্য, তখন শ্মশানস্থলে দূরাগত গৃগণের পরস্পরের মধ্যে যে সকল চাতুরীপ্রবঞ্চনা-হানাহানি পড়িয়া গেল, তাহাও কি ভারতবর্ষের ইতিবৃত্ত? এবং তাহার পর হইতে পাঁচ পাঁচ বৎসরে বিভক্ত ছককাটা সতরঞ্চের মত ইংরাজশাসন, ইহার মধ্যে ভারতবর্ষ আরো ক্ষুদ্র;—বস্তুত সতরঞ্চের সহিত ইহার প্রভেদ এই যে, ইহার ঘরগুলি কালেয়-শাদায় সমান বিভক্ত নহে, ইহার পনেরোআনাই শাদা। আমরা পেটের অল্পের বিনিময়ে সুশাসন, সুবিচার, সুশিক্ষা, সমস্তই একটি বৃহৎ হোয়াইট্যাওয়ে-লেড্‌ল-র দোকান হইতে কিনিয়া লইতেছি—আর সময় দোকান পাট বন্ধ। এই কারখানাটির বিচার হইতে বাণিজ্য পর্য্যন্ত সমস্তই সু হইতে পারে, কিন্তু ইহার মধ্যে কেরাণীশালার এককোণে আমাদের ভারতবর্ষের স্থান অতি যৎসামান্য।

 ইতিহাস সকল দেশে সমান হইবেই, এ কুসংস্কার বর্জন না করিলে নয়। যে ব্যক্তি রথচাইল্ডের জীবনী পড়িয়া পাকিয়া গেছে, সে খৃষ্টের জীবনীর বেলায় তাহার হিসাবের খাতাপত্র ও আপিসের ডায়ারি তলব করিতে পারে; যদি সংগ্রহ করিতে না পারে, তবে তাহার অবজ্ঞা জন্মিবে এবং সে বলিবে, যাহার এক পয়সার সঙ্গতি ছিল না, তাহার আবার জীবনী কিসের? তেমনি ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় দফতর হইতে তাহার রাজবংশমালা ও জয়পরাজয়ের কাগজপত্র না পাইলে যাহারা ভারতবর্ষের ইতিহাসসম্বন্ধে হতাশ্বাস হইয়া পড়েন এবং বলেন, যেখানে পলিটিক্স নাই, সেখানে আবার হিষ্ট্রী কিসের, তাহারা ধানের ক্ষেতে বেগুন খুঁঁজিতে যান এবং না পাইলে মনের ক্ষোভে ধানকে শস্যের মধ্যেই গণ্য করেন না। সকল ক্ষেতের আবাদ এক নহে, ইহা জানিয়া, যে ব্যক্তি যথাস্থানে উপযুক্ত শস্যের প্রত্যাশা করে, সেই প্রাজ্ঞ।

 যিশুখৃষ্টের হিসাবে খাতা দেখিলে তাহার প্রতি অবজ্ঞা জন্মিতে পারে, কিন্তু তাহার অন্য বিষয় সন্ধান করিলে খাতাপত্র সমস্ত নগণ্য হইয়া যায়। তেমনি রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ভারতবর্ষকে দীন বলিয়া জানিয়াও অন্য বিশেষ দিক হইতে সে দীনতাকে তুচ্ছ করিতে পারা যায়। ভারতবর্ষের সেই নিজের দিক হইতে ভারতবর্ষকে না দেখিয়া, আমরা শিশুকাল হইতে তাহাকে খর্ব্ব করিতেছি ও নিজে খর্ব্ব হইতেছি। ইংরাজের ছেলে জানে, তাহার বাপ-পিতামহ অনেক যুদ্ধজয়, দেশ-অধিকার ও বাণিজ্যব্যবসায় করিয়াছে, সে-ও নিজেকে গণগৌরব, ধনগৌরব, রাজ্যগৌরবের অধিকারী করিতে চায়। আমরা জানি, আমাদের পিতামহগণ দেশ-অধিকার ও বাণিজ্যবিস্তার করেন নাই—এইটে জানাইবার জন্যই ভারতবর্ষের ইতিহাস। তাঁহারা কি করিয়াছিলেন জানি না, সুতরাং আমরা কি করিব, তাহাও জানি না। সুতরাং পরের নকল করিতে হয়।

 ইহার অন্য কাহাকে দোষ দিব? ছেলেবেলা হইতে আমরা যে প্রণালীতে যে শিক্ষা পাই, তাহাতে প্রতিদিন দেশের সহিত আমাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়া ক্রমে দেশের বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহভাব জন্মে।

 আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরাও ক্ষণে ক্ষণে হতবুদ্ধির ন্যায় বলিয়া উঠেন, দেশ তুমি কাহাকে বল, আমাদের দেশের বিশেষ ভাবটা কি, তাহা কোথায় আছে, তাহা কোথায় ছিল? প্রশ্ন করিয়া ইহার উত্তর পাওয়া যায় না। কারণ, কথাটা এত সূক্ষ্ম, এত বৃহৎ যে, ইহা কেবলমাত্র যুক্তির দ্বারা বোধগম্য নহে। ইংরাজ বল, ফরাসী বল, কোন দেশের লোকই আপনার দেশীয় ভাবটি কি, দেশের মূল মর্মস্থানটি কোথায়, তাহা এক কথায় ব্যক্ত করিতে পারে না—তাহা দেহস্থিত প্রাণের ন্যায় প্রত্যক্ষ সত্য, অথচ প্রাণের ন্যায় সংজ্ঞা ও ধারণার পক্ষে দুর্গম। তাহা শিশুকাল হইতে আমাদের জ্ঞানের ভিতর, আমাদের প্রেমের ভিতর, আমাদের কল্পনার ভিতর নানা অলক্ষ্য পথ দিয়া নানা আকারে প্রবেশ করে। সে তাহার বিচিত্র শক্তি দিয়া আমাদিগকে নিগূঢ়ভাবে গড়িয়া তোলে-আমাদের অতীতের সহিত বর্ত্তমানের ব্যবধান ঘটিতে দেয় না—তাহারই প্রসাদে আমরা বৃহৎ, আমরা বিচ্ছিন্ন নহি। এই বিচিত্র উদ্যমসম্পন্ন গুপ্ত পুরাতনী শক্তিকে সংশয়ী জিজ্ঞাসুর কাছে আমরা সংজ্ঞার দ্বারা দুই-চার কথায় ব্যক্ত করিব কি করিয়া?

 ভারতবর্ষের প্রধান সার্থকতা কি, এ কথা স্পষ্ট উত্তর যদি কেহ জিজ্ঞাসা করেন, সে উত্তর আছে; ভারতবর্ষের ইতিহাস সেই উত্তরকেই সমর্থন করিবে। ভারতবর্ষের চিরদিনই একমাত্র চেষ্টা দেখিতেছি, প্রভেদের মধ্যে ঐক্যস্থাপন করা, নানা পথকে একই লক্ষ্যের অভিমুখীন করিয়া দেওয়া এবং বহুর মধ্যে এককে নিংসংশয়রূপে অন্তরতররূপে উপলব্ধি করা,—বাহিরে যে সকল পার্থক্য প্রতীয়মান হয়, তাহাকে নষ্ট না করিয়া তাহার ভিতরকার নিগূঢ় যোগকে অধিকার করা।

 এই এককে প্রত্যক্ষ করা এবং ঐক্যবিস্তারের চেষ্টা করা ভারতবর্ষের পক্ষে একান্ত স্বাভাবিক। তাহার এই স্বাভাবই তাহাকে চিরদিন রাষ্ট্রগৌরবের প্রতি উদাসীন করিয়াছে। কারণ, রাষ্ট্রগৌরবের মূলে বিরোধের ভাব। যাহারা পরকে একান্ত পর বলিয়া সর্ববান্তঃকরণে অনুভব না করে, তাহারা রাষ্ট্রগৌরবলাভকে জীবনের চরম লক্ষ্য বলিয়া মনে করিতে পারে না। পরের বিরুদ্ধে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিবার যে চেষ্টা, তাহাই পোলিটিক্যাল্‌ উন্নতির ভিত্তি—এবং পরের সহিত আপনার সম্বন্ধবন্ধন ও নিজের ভিতরকার বিচিত্র বিভাগ ও বিরোধের মধ্যে সামঞ্জস্যস্থাপনের চেষ্টা, ইহাই ধর্মনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির ভিত্তি। য়ুরোপীয় সভ্যতা যে ঐক্যকে আশ্রয় করিয়াছে, তাহা বিরোধমূলক; ভারতবর্ষীয় সভ্যতা যে ঐক্যকে আশ্রয় করিয়াছে, তাহা মিলনমূলক। য়ুরোপীয় পোলিটিক্যাল্‌ ঐক্যের ভিতরে যে বিরোধের ফাঁস রহিয়াছে, তাহা তাহাকে পরের বিরুদ্ধে টানিয়া রাখিতে পারে, কিন্তু তাহাকে নিজের মধ্যে সামঞ্জস্য দিতে পারে না। এইজন্য তাহা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, রাজায় প্রজায়, ধনীতে দরিদ্রে বিচ্ছেদ ও বিরোধকে সর্ববদা জাগ্রত করিয়াই রাখিয়াছে। তাহারা সকলে মিলিয়া যে নিজ নিজ নির্দিষ্ট অধিকারের দ্বারা সমগ্র সমাজকে বহন করিতেছে, তাহা নয়, তাহারা পরস্পরের প্রতিকুল—যাহাতে কোন পক্ষের বলবৃদ্ধি না হয়, অপর পক্ষের ইহাই প্রাণপণ সতর্ক চেষ্টা। কিন্তু সকলে মিলিয়া যেখানে ঠেলাঠেলি করিতেছে, সেখানে বলের সামঞ্জস্য হইতে পারে না—সেখানে কালক্রমে জনসংখ্য যোগ্যতার অপেক্ষা বড় হইয় উঠে, উদ্যম গুণের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতা লাভ করে এবং বণিকের ধনসংহতি গৃহস্থের ধনভাণ্ডারগুলিকে অভিভূত করিয়া ফেলে—এইরূপে সমাজের সামঞ্জস্য নষ্ট হইয়া যায় এবং এই সকল বিসদৃশ বিরোধী অঙ্গ গুলিকে কোনমতে জোড়াতাড়া দিয়া রাখিবার জন্য গবর্মেণ্ট্‌ কেবলই আইনের পর আইন স্থষ্টি করিতে থাকে। ইহা অবশ্যম্ভাবী। কারণ বিরোধ যাহার বীজ, বিরোধই তাহার শস্য; মাঝখানে যে পরিপুষ্ট পল্লবিত ব্যাপারটিকে দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা এই বিরোধশস্যেরই প্রাণবান্‌ বলবান্‌ বৃক্ষ।

 ভারতবর্ষ বিসদৃশকেও সম্বন্ধবন্ধনে বাঁধিবার চেষ্টা করিয়াছে। যেখানে যথার্থ পার্থক্য আছে, সেখানে সেই পার্থক্যকে যথাযোগ্য স্থানে বিন্যস্ত করিয়া—সংযত করিয়া তবে তাহাকে ঐক্যদান করা সম্ভর। সকলেই এক হইল বলিয়া আইন করিলেই এক হয় না। যাহার এক হইবার নহে, তাহারের মধ্যে সম্বন্ধস্থাপনের উপায় তাহাদিগকে পৃথক্‌ অধিকারের মধ্যে বিভক্ত করিয়া দেওয়া। পৃথককে বলপূর্ববক এক করিলে তাহারা একদিন বলপূর্ব্বক বিছিন্ন হইয়া যায়, সেই বিচ্ছেদের সময় প্রলয় ঘটে। ভারতবর্ষ মিলনসাধনের এই রহস্ত জানিত। ফরাসীবিদ্রোহ গায়ের জোরে মানবের সমস্ত পার্থক্য রক্ত দিয়া মুছিয়া ফেলিবে, এমন স্পর্দ্ধা করিয়াছিল—কিন্তু ফল উলটা হইয়াছে—যুরোপে রাজশক্তি-প্রজাশক্তি, ধনশক্তি জনশক্তি, ক্রমেই অত্যন্ত বিরূদ্ধ হইয়া উঠিতেছে। ভারতবর্ষের লক্ষ্য ছিল সকলকে ঐক্যসুত্রে আবদ্ধ করা, কিন্তু তাহার উপায় ছিল স্বতন্ত্র। ভারতবর্ষ সমাজের সমস্ত প্রতিযোগী বিরোধী শক্তিকে সীমাবদ্ধ ও বিভক্ত করিয়া সমাজকলেবরকে এক এবং বিচিত্রকর্ম্মের উপযোগী করিয়াছিল—নিজ নিজ অধিকারকে ক্রমাগতই লঙ্ঘন করিবার চেষ্টা করিয়া বিরোধ-বিশৃঙ্খলা জাগ্রত করিয়া রাখিতে দেয় নাই। পরস্পর প্রতিযোগিতার পথেই সমাজের সকল শক্তিকে অহরহ সংগ্রামপরায়ণ করিয়া তুলিয়া ধর্ম্ম-কর্ম্ম গৃহ সমস্তকেই আবর্ত্তিত, আবিল, উদ্ভ্রান্ত করিয়া রাখে নাই। ঐক্যনির্ণয়, মিলনসাধন, এবং শান্তি ও স্থিতির মধ্যে পরিপূর্ণ পরিণতি ও মুক্তিলাভের অবকাশ, ইহাই ভারতবর্ষের লক্ষ্য ছিল।

 বিধাতা ভারতবর্ষের মধ্যে বিচিত্র জাতিকে টানিয়া আনিয়াছেন। ভারতবর্ষীয় আর্য্য যে শক্তি পাইয়াছে, সেই শক্তি চর্চ্চা করিবার অবসর ভারতবর্ষ অতি প্রাচীনকাল হইতেই পাইয়াছে। ঐক্যমূলক যে সভ্যতা মানবজাতির চরম সভ্যতা, ভারতবর্ষ চিরদিন ধরিয়া বিচিত্র উপকরণে তাহার ভিত্তিনির্ম্মাণ করিয়া আসিয়াছে। পর বলিয়া সে কাহাকেও দূর করে নাই, অনার্য্য বলিয়া সে কাহাকেও বহিষ্কৃত করে নাই, অসঙ্গত বলিয়া সে কিছুকেই উপহাস করে নাই। ভারতবর্ষ সমস্তই গ্রহণ করিয়াছে, সমস্তই স্বীকার করিয়াছে। এত গ্রহণ করিয়াও আত্মরক্ষা করিতে হইলে এই পুঞ্জীভূত সামগ্রীর মধ্যে নিজের ব্যবস্থা, নিজের শৃঙ্খলা স্থাপন করিতে হয়—পশুযুদ্ধভূমিতে পশুদলের মত ইহাদিগকে পরস্পরের উপর ছাড়িয়া দিলে চলে না। ইহাদিগকে বিহিত নিয়মে বিভক্ত-স্বতন্ত্র করিয়া একটি মূলভাবের দ্বারা বদ্ধ করিতে হয়। উপকরণ যেখানকার হউক, সেই শৃঙ্খলা ভারতবর্ষের, সেই মূলভাবটি ভারতবর্ষের। য়ুরোপ পরকে দূর করিয়া, উৎসাদন করিয়া সমাজকে নিরাপদ্‌ রাখিতে চায়; আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, নিয়ুজীলাণ্ড, কেপ্‌-কলনিতে তাহার পরিচয় আমরা আজ পর্যন্ত পাইতেছি। ইহার কারণ, তাহার নিজের সমাজের মধ্যে একটি সুবিহিত শৃঙ্খলার ভাব নাই—তাহার নিজেরই ভিন্ন সম্প্রদায়কে সে যথোচিত স্থান দিতে পারে নাই এবং যাহারা সমাজের অঙ্গ, তাহাদের অনেকেই সমাজের বোঝার মত হইয়াছে—এরূপ স্থলে বাহিরের লোককে সে সমাজ নিজের কোন্‌খানে আশ্রয় দিবে? আত্মীয়ই যেখানে উপদ্রব করিতে উদ্যত, সেখানে বাহিরের লোককে কেহ স্থান দিতে চায় না। যে সমাজে শৃঙ্খলা আছে, ঐক্যের বিধান আছে, সকলের স্বতন্ত্র স্থান ও অধিকার আছে, সেই সমাজেই পরকে আপন করিয়া লওয়া সহজ। হয় পরকে কাটিয়া-মারিয়া খেদাইয়া নিজের সমাজ ও সভ্যতাকে রক্ষা করা, নয় পরকে নিজের বিধানে সংযত করিয়া সু-বিহিত শৃঙ্খলার মধ্যে স্থান করিয়া দেওয়া, এই দুইরকম হইতে পারে। যুরোপ প্রথম প্রণালীটি অবলম্বন করিয়া সমস্ত বিশ্বের সঙ্গে বিরোধ উন্মুক্ত করিয়া রাখিয়াছে-ভারতবর্ষ দ্বিতীয় প্রণালী অবলম্বন করিয়া সকলকেই ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে আপনার করিয়া লইবার চেষ্টা করিয়াছে। যদি ধর্ম্মের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে, যদি ধর্ম্মকেই মানবসভ্যতার চরম আদর্শ বলিয়া স্থির করা যায়, তবে ভারতবর্ষের প্রণালীকেই শ্রেষ্ঠতা দিতে হইবে।

 পরকে আপন করিতে প্রতিভার প্রয়োজন। শেক্সপিয়র কোথা হইতে কি আত্মসাৎ করিয়াছেন, তাহা সন্ধান করিতে বসিলে নানা ভাণ্ডারেই তাহার প্রবেশাধিকার আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু আপনার করিবার শক্তি ছিল বলিয়াই তিনি এত লইতে পারিয়াছেন। অন্যের মধ্যে প্রবেশ করিবার শক্তি এবং অন্যকে সম্পূর্ণ আপনার করিয়া লইবার ইন্দ্রজাল, ইহাই প্রতিভার নিজস্ব। ভারতবর্ষের মধ্যে সেই প্রতিভা আমরা দেখিতে পাই। ভারতবর্ষ অসঙ্কোচে অন্যের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে এবং অনায়াসে অন্তের সামগ্রী নিজের করিয়া লইয়াছে। বিদেশী যাহাকে পৌত্তলিকতা বলে, ভারতবর্ষ তাহাকে দেখিয়া ভীত হয় নাই, নাসা কুঞ্চিত করে নাই। ভারতবর্ষ পুলিন্দ, শবর, ব্যাধ প্রভৃতিদের নিকট হইতেও বীভৎস সামগ্রী গ্রহণ করিয়া তাহার মধ্যেনিজের ভাব বিস্তার করিয়াছে—তাহার মধ্য দিয়াও নিজের আধ্যাত্মিকতাকে অভিব্যক্ত করিয়াছে। ভারতবর্ষ কিছুই ত্যাগ করে নাই এবং গ্রহণ করিয়া সকলই আপনার করিয়াছে

 এই ঐক্যবিস্তার ও শৃঙ্খলাস্থাপন কেবল সমাজব্যবস্থায় নহে, ধর্ম্মনীতিতেও দেখি। গীতায় জ্ঞান, প্রেম ও কর্ম্মের মধ্যে যে সম্পূর্ণসামঞ্জস্য-স্থাপনের চেষ্টা দেখি, তাহা বিশেষরূপে ভারতবর্ষের। যুরোপে রিলিজ্ন্‌ বলিয়া যে শব্দ আছে, ভারতবর্ষীয় ভাষায় তাহার অনুবাদ অসম্ভব—কারণ ভারতবর্ষ ধর্ম্মের মধ্যে মানসিক বিচ্ছেদ ঘটিতে বাধা দিয়াছে—আমাদের বুদ্ধি-বিশ্বাস-আচরণ, আমাদের ইহকাল পরকাল, সমস্ত জড়াইয়াই ধর্ম্ম। ভারতবর্ষ তাহাকে খণ্ডিত করিয়া কোনটাকে পোষাকী এবং কোনটাকে আটপৌরে করিয়া রাখে নাই। হাতের জীবন, পায়ের, জীবন, মাথার জীবন, উদরের জীবন যেমন আলাদা নয়, বিশ্বাসের ধর্ম্ম, আচরণের ধর্ম্ম, রবিবারের ধর্ম্ম, অপর ছয়দিনের ধর্ম্ম, গির্জার ধর্ম্ম এবং গৃহের ধর্ম্মে ভারতবর্ষ ভেদ ঘটাইয়া দেয় নাই। ভারতবর্ষের ধর্ম্ম সমস্ত সমাজেরই ধর্ম্ম—তাহার মূল মাটির ভিতরে এবং মাথা আকাশের মধ্যে—তাহার মূলকে স্বতন্ত্র ও মাথাকে স্বতন্ত্র করিয়া ভারতবর্ষ দেখে নাই—ধর্ম্মকে ভারতবর্ষ দ্যুলোকভূলোকব্যাপী, মানবের সমস্ত জীবনব্যাপী একটি বৃহৎ বনস্পতিরূপে দেখিয়াছে।


পৃথিবীর সভাসমাজের মধ্যে ভারতবর্ষ নানাকে এক করিবার আদর্শরূপে বিরাজ করিতেছে, তাহার ইতিহাস হইতে ইহাই প্রতিপন্ন হইবে। এককে বিশ্বের মধ্যে ও নিজের আত্মার মধ্যে অনুভব করিয়া সেই এককে বিচিত্রের মধ্যে স্থাপন করা, জ্ঞানের দ্বারা আবিষ্কার করা, কর্ম্মের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা, প্রেমের দ্বারা উপলব্ধি করা এবং জীবনের দ্বারা প্রচার করা—নানা বাধা-বিপত্তি-দুর্গতি-সুগতির মধ্যে ভারতবর্ষ ইহাই করিতেছে। ইতিহাসের ভিতর দিয়া যখন ভারতের সেই চিরন্তন ভাবটি অনুভব করিব, তখন আমাদের বর্ত্তমানের সহিত অতীতের বিচ্ছেদ লোপ পাইবে।

 বিদেশের শিক্ষা ভারতবর্ষকে অতীতে ও বর্ত্তমানে দ্বিধা বিভক্ত করিতেছে। যিনি সেতু নির্ম্মাণ করিবেন, তিনি আমাদিগকে রক্ষা করিবেন। যদি সেই সেতু নির্ম্মিত হয়, তবে এই দ্বিধারও সফলতা আছে—কারণ বিচ্ছেদের আঘাত না পাইলে মিলন সচেতন হয় না। যদি আমাদের মধ্যে কিছুমাত্র পদার্থ থাকে, তবে বিদেশ আমাদিগকে যে আঘাত করিতেছে, সেই আঘাতে স্বদেশকেই আমরা নিবিড়তররূপে উপলব্ধি করিব। প্রবাসে নির্ব্বাসনই আমাদের কাছে গৃহের মাহাত্ম্যকে মহত্তম করিয়া তুলিবে।


 মামুদ ও মহম্মদ্ঘোরীর বিজয়বার্ত্তার সমস্ত তারিখ আমরা মুখস্থ করিয়া পরীক্ষার প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হইয়াছি, এখন যিনি সমস্ত ভারতবর্ষকে আমাদের সম্মুখে মূর্ত্তিমান্‌ করিয়া তুলিবেন, অন্ধকারের মধ্যে দাড়াইয়া সেই ঐতিহাসিককে আমরা আহবান করিতেছি। তিনি তাহার শ্রদ্ধার দ্বারা আমাদের মধ্যে শ্রদ্ধার সঞ্চার করিবেন, আমাদিগকে প্রতিষ্ঠাদান করিবেন, আমাদের আত্ম-উপহাস আত্মঅবিশ্বাসকে অতি অনায়াসে তিরস্কৃত করিবেন, আমাদিগকে এমন প্রাচীন সম্পদের অধিকারী করিবেন যে, পরের ছদ্মবেশে নিজের লজ্জা লুকাইবার আর প্রবৃত্তি থাকিবে না। তখন এ কথা আমরা বুঝিব, পৃথিবীতে ভারতবর্ষের একটি মহৎ স্থান আছে, আমাদের মধ্যে মহৎ আশার কারণ আছে; আমরা কেবল গ্রহণ করিব না— অনুকরণ করিব না, দান করিব—প্রবর্ত্তন করিব, এমন সম্ভাবনা আছে; পলিটিক্স এবং বাণিজ্যই আমাদের চরমতম গতিমুক্তি নহে, প্রাচীন ব্রহ্মচর্য্যের পথে বৈরাগ্য-কঠিন দারিদ্র্যগৌরব শিরোধার্য্য করিয়া দুর্গম-নির্ম্মল মাহাত্ম্যের উন্নততম শিখরে অধিরোহণ করিবার জন্য আমাদের ঋষি-পিতামহদের সুগম্ভীর নিদেশ-নির্দ্দেশ প্রাপ্ত হইয়াছি; সে পথে পণ্যভারাক্রান্ত অন্য কোন পান্থ নাই বলিয়া আমরা ফিরিব না, গ্রন্থভারনত শিক্ষকমহাশয় সে পথে চলিতেছেন না বলিয়া লজ্জিত হইব না। মূল্য না দিলে কোন মূল্যবান্‌ জিনিষকে আপনার করা যায় না। ভিক্ষা করিতে গেলে কেবল খুদকুঁড়া মেলে, তাহাতে পেট অল্পই ভরে, অথচ জাতিও থাকে না। বিদেশকে যতক্ষণ আমরা কিছু দিতে পারি না, বিদেশ হইতে ততক্ষণ আমরা কিছু লইতেও পারি না; লইলেও তাহার সঙ্গে আত্মসম্মান থাকে না বলিয়াই তাহা তেমন করিয়া আপনার হয় না, সঙ্কোচে সে অধিকার চিরদিন অসম্পূর্ণ ও অসঙ্গত হইয়া থাকে। যখন গৌরবসহকারে দিব, তখন গৌরব সহকারে লইব। হে ঐতিহাসিক, আমাদের সেই দিবার সঙ্গতি কোন্ প্রাচীন ভাণ্ডারে সঞ্চিত হইয়া আছে, তাহা দেখাইয়া দাও, তাহার দ্বার উদঘাটন কর। তাহার পর হইতে আমাদের গ্রহণ করিবার শক্তি বাধাহীন ও অকুণ্ঠিত হইবে, আমাদের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি অকৃত্রিম ও স্বভাবসিদ্ধ হইয়া উঠিবে। ইংরাজ নিজেকে সর্ব্বত্র প্রসারিত, দ্বিগুণিত, চতুর্গুণিত করাকেই জগতের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ শ্রেয় বলিয়া জ্ঞান করিয়াছে, তাহাদের বুদ্ধিবিচারের এই উন্মত্ত অন্ধ অবস্থায় তাহারা ধৈর্য্যের সহিত আমাদিগকে শিক্ষাদান করিতে পারে না। উপনিষদে অনুশাসন আছে—শ্রদ্ধয়া দেয়ম্‌, অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম্‌—শ্রদ্ধার সহিত দিবে, অশ্রদ্ধার সহিত দিবে না— কারণ, শ্রদ্ধার সহিত না দিলে যথার্থ জিনিষ দেওয়াই যায় না, বরঞ্চ এমন একটা জিনিষ দেওয়া হয়, যাহাতে গ্রহীতাকে হীন করা হয়। আজকালকার ইংরাজশিক্ষকগণ দানের দ্বারা আমাদিগকে হীন করিয়া থাকেন,— তাঁঁহারা অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধার সহিত দান করেন, সেই সঙ্গে প্রত্যহ সবিদ্রূপে স্মরণ করাইতে থাকেন—“যাহা দিতেছি, ইহার তুল্য তোমাদেরর কিছুই নাই এবং যাহা লইতেছ, তাহার প্রতিদান দেওয়া তোমাদের সাধ্যের অতীত।” প্রত্যহ এই অবমাননার বিষ আমাদের মজ্জার মধ্যে প্রবেশ করে, ইহাতে পক্ষাঘাত আনিয়া আমাদিগকে নিরুদ্যম করিয়া দেয়। শিশুকাল হইতেই নিজের নিজত্ব উপলব্ধি করিবার কোন অবকাশ—কোন সুযোগ পাই নাই, পরভাষার বানান-বাক্য-ব্যাকরণ ও মতামতের দ্বারা উদ্‌ভ্রান্ত-অভিভূত হইয়া আছি—নিজের কোন শ্রেষ্ঠতার প্রমাণ দিতে না পারিয়া মাথা হেঁট করিয়া থাকিতে হয়। ইংরেজের নিজের ছেলেদের শিক্ষাপ্রণালী এরূপ নহে— অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজে তাঁহাদের ছেলে কেবল যে গিলিয়া থাকে, তাহা নহে, তাহারা আলোক, আলোচনা ও খেলা হইতে বঞ্চিত হয় না। অধ্যাপকদের সঙ্গে তাহাদের সুদূর কলের সম্বন্ধ নহে। একে ত তাহাদের চতুর্দ্দিকবর্ত্তী স্বদেশী সমাজ স্বদেশী শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে আপন করিয়া লইবার জন্য শিশুকাল হইতে সর্ব্বতোভাবে আনুকূল্য করিয়া থাকে, তাহার পরে শিক্ষাপ্রণালী ও অধ্যাপকগণও অনুকূল। আমাদের আদ্যোপান্ত সমস্তই প্রতিকূল—যাহা শিখি, তাহা প্রতিকূল, যে উপায়ে শিখি, তাহা প্রতিকুল, যে শেখায়, সে-ও প্রতিকূল। ইহা সত্ত্বেও যদি আমরা কিছু লাভ করিয়া থাকি, যদি এ শিক্ষা আমরা কোন কাজে খাটাইতে পারি, তাহা আমাদের গুণ।

 অবশ্য এই বিদেশী শিক্ষাধিক্কারের হাত হইতে স্বজাতিকে মুক্তি দিতে হইলে শিক্ষার ভার আমাদের নিজের হাতে লইতে হইবে এবং যাহাতে শিশুকাল হইতে ছেলেরা স্বদেশীয় ভাবে, স্বদেশীয় প্রণালীতে, স্বদেশের সহিত হৃদয়মনের যোগরক্ষা করিয়া, স্বদেশের বায়ু ও আলোক প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত রাখিয়া শিক্ষা পাইতে পারে, তাহার জয় আমাদিগকে একান্ত প্রযত্নে চেষ্টা করিতে হইবে। ভারতবর্ষ সুদীর্ঘকাল ধরিয়া আমাদের মনের যে প্রকৃতিকে গঠন করিয়াছে, তাহাকে নিজের বা পরের ইচ্ছামত বিকৃত করিলে, আমরা জগতে নিষ্ফল ও লজ্জিত হইব। সেই প্রকৃতিকেই পূর্ণপরিণতি দিলে সে অনায়াসেই বিদেশের জিনিষকে আপনার করিয়া লইতে পারিবে এবং আপনার জিনিষ বিদেশকে দান করিতে পারিবে।

 এই স্বদেশী প্রাণালীর শিক্ষার প্রধান ভিত্তি স্বার্থত্যাগপর ভৃতিনিরপেক্ষ অধ্যয়ন-অধ্যাপনরত নিষ্ঠাবান্ গুরু এবং তাহার অধ্যাপনের প্রধান অবলম্বন স্বদেশের একখানি সম্পূর্ণ ইতিহাস। এক দিন এইরূপ গুরু আমাদের দেশে গ্রামে-গ্রামেই ছিলেন—তাঁঁহাদের ‘জুতামোজা, গাড়িঘোড়া, আস্‌বাব্‌ পত্রের প্রয়োজনই ছিল না-নবাব ও নবাবের অনুকারিগণ তাঁহাদের চারিদিকে নবাবী করিয়া বেড়াইত, তাহাতে তাঁহাদের দৃক্‌পাত ছিল না, তাঁহাদের অগৌরব ছিল না। এখনো আমাদের দেশে সেই সকল গুরুর অভাব নাই। কিন্তু শিক্ষার বিষয় পরিবর্ত্তিত হইয়াছে—এখন ব্যাকরণ, স্মৃতি ও ন্যায় আমাদের জঠরালনির্ব্বাণের সহায়তা করে না এবং আধুনিক কালের জ্ঞানস্পৃহা মিটাইতে পারে না। কিন্তু যাঁহারা নূতন শিক্ষাদানের অধিকারী হইয়াছেন, তাঁহাদের চাল বিগ্‌ড়াইয়া গেছে, তাঁহাদের আদর্শ বিকৃত হইয়াছে, তাঁহারা অল্পে সন্তুষ্ট নহেন, বিদ্যাদানকে তাঁহারা ধর্ম্মকর্ম্ম বলিয়া জানেন না, বিদ্যাকে তাঁহারা পণ্যদ্রব্য করিয়া বিদ্যাকেও হীন করিয়াছেন, নিজেকেও হেয় করিয়াছেন। নব্যশিক্ষিতদের মধ্যে আমাদের সামাজিক উচ্চ আদর্শের এই বিপর্য্যয়দশা একদিন সংশোধিত হইবে—ইহা আমি দুরাশা বলিয়া গণ্য করি না। আমাদের বৃহৎ-শিক্ষিতমণ্ডলীর মধ্যে ক্রমে ক্রমে এমন দুই-চারিটি লোক নিশ্চয়ই উঠিবেন, যাহারা বিদ্যাব্যবসায়কে ঘৃণা করিয়া বিদ্যাদানকে কৌলিক ব্রত বলিয়া গ্রহণ করিবেন। তাঁহারা জীবনযাত্রার উপকরণ সংক্ষিপ্ত করিয়া, বিলাস বিসর্জন দিয়া, দেশের স্থানে স্থানে যে আধুনিক শিক্ষায় টোল করিবেন, ইন্‌স্পেক্টরের গর্জ্জন ও য়ুনিভারসিটির তর্জ্জন বর্জ্জিত সেই সকল টোলেই বিদ্যা স্বাধীনতালাভ করিবে, মর্য্যাদালাভ করিবে। ইংরাজ রাজবণিকের দৃষ্টান্ত ও শিক্ষা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এমনতর জনকয়েক গুরুকে জন্ম দিতে পারিবে, এ বিশ্বাস আমার মনে দৃঢ় রহিয়াছে।