যোগাযোগ/১২

উইকিসংকলন থেকে

১২

 বিপ্রদাস আবও কয়েকবার কুমুদিনীকে বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করলে। কুমু কথার জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে আঁচল খুঁটতে লাগল। বিয়ের প্রস্তাব পাকা, কেবল একটা বিষয় নিয়ে দুই পক্ষে কিছু কথাচালাচালি হল। বিয়েটা হবে কোথায়? বিপ্রদাসের ইচ্ছে কলকাতার বাড়িতে। মধুসূদনের একান্ত জেদ নুরনগরে। বরপক্ষের ইচ্ছেই বাহাল রইল।

 আয়োজনের জন্যে কিছু আগে থাকতেই নুরনগরে আসতে হল। বৈশেখ-জষ্টির খরার পরে আষাঢ়ের বৃষ্টি নামলে মাটি যেমন দেখতে দেখতে সবুজ হয়ে আসে, কুমুদিনীর অন্তরে-বাহিরে তেমনি একটা নূতন প্রাণের রং লাগল। আপন-মনগড়া মানুষের সঙ্গে মিলনের আনন্দ ওকে অহরহ পুলকিত করে রাখে। শরৎকালের সোনার আলো ওর সঙ্গে চোখে চোখে কথা কইছে, কোন্ এক অনাদিকালেব মনের কথা। শোবার ঘরের সামনের বারান্দায় কুমু মুড়ি ছড়িয়ে দেয়, পাখিরা এসে এসে খায়; রুটির টুকরো রাখে, কাঠবিড়ালি চঞ্চল চোখে চারিদিকে চেয়ে দ্রুত ছুটে এসে লেজের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ায়; সামনের দুই পায়ে রুটি তুলে ধরে কুটুর কুটুর করে খেতে থাকে। কুমুদিনী আড়াল থেকে আনন্দিত হয়ে বসে দেখে। বিশ্বের প্রতি ওর অন্তর আজ দাক্ষিণ্যে ভরা। বিকেলে গা খোবার সময় খিড়কির পুকুরে গলা ডুবিয়ে চুপ করে বসে থাকে, জল যেন ওর সর্বাঙ্গে আলাপ করে। বিকেলের বাঁকা আলো পুকুরের পশ্চিম- ধারের বাতাবিলেবুগাছের শাখার উপর দিয়ে এসে ঘন কালাে জলের উপরে নিকষে সােনার রেখার মতাে ঝিকিমিকি করতে থাকে; ও চেয়ে চেয়ে দেখে, সেই আলােয় ছায়ায় ওর সমস্ত শরীরের উপর দিয়ে অনির্বচনীয় পুলকের কাঁপন বয়ে যায়। মধ্যাহ্নে বাড়ির ছাদের চিলেকোঠায় একলা গিয়ে বসে থাকে, পাশের জামগাছ থেকে ঘুঘুর ডাক কানে আসে। ওর যৌবন-মন্দিরে আজ যে-দেবতার বরণ হচ্ছে ভাবঘন রসের রূপটি তার, কৃষ্ণরাধিকার যুগলরূপের মাধুর্য তার সঙ্গে মিশেছে। বাড়ির ছাদের উপরে এসরাজটি নিয়ে ধীরে ধীরে বাজায়, ওর দাদার সেই ভূপালী সুরের গানটি:

আজু মাের ঘরে আইল পিয়রওয়া
রােমে রােমে হরখীলা।

 রাত্রে বিছানায় বসে প্রণাম করে, সকালে উঠে বিছানায় বসে আবার প্রণাম করে। কাকে করে সেটা স্পষ্ট নয়,—একটি নিরবলম্ব ভক্তির স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস।

 কিন্তু মনগড়া প্রতিমার মন্দিরদ্বার চিরদিন তাে রুদ্ধ থাকতে পারে না। কানাকানির নিশ্বাসের তাপে ও বেগে সে-মূর্তির সুষমা যখন ঘা খেতে আরম্ভ করে তখন দেবতার রূপ টিঁকবে কী করে। তখন ভক্তের বড়ো দুঃখের দিন।

 একদিন তেলেনিপাড়ার বুড়ী তিনকড়ি এসে কুমুদিনীর মুখের সামনেই বলে বসল, “হ্যাঁ গা, আমাদের কুমুর কপালে কেমন রাজা জুটল? ওই যে বেদেনীদের গান আছে,

এক-যে ছিল কুকুর-চাটা শেয়ালকাঁটার বন,
কেটে করলে সিংহাসন।

 এ-ও সেই শেয়ালকাঁটা-বনের রাজা। ওই তাে রজবপুরের আন্দো মুহুরির ছেলে মােধো। দেশে যে-বার আকাল, মগের মুলুক থেকে চাল, আনিয়ে বেচে ওর টাকা। তবু বুড়ী মাকে শেষদিন পর্যন্ত রাঁধিয়ে রাঁধিয়ে হাড় কালি করিয়েছে।”

 মেয়েরা উৎসুক হয়ে তিনকড়িকে ধরে বসে; বলে, “বরকে জানতে না কি?”

 “জানতুম না? ওর মা যে আমাদের পাড়ার মেয়ে, পুরুত চক্রবর্তীদের ঘরের। (গলা নিচু করে) সত্যি কথা বলি বাছা, ভালাে বামনের ঘরে ওদের বিয়ে চলে না। তা হােক গে, লক্ষ্মী তাে জাতবিচার করেন না।”

 পূর্বেই বলেছি কুমুদিনীর মন একালের ছাঁচে নয়। জাতকুলের পবিত্রতা তার কাছে খুব একটা বাস্তব জিনিস। মনটা তাই যতই সংকুচিত হয়ে ওঠে ততই যারা নিন্দে করে তাদের উপর রাগ করে; ঘর থেকে হঠাৎ কেঁদে উঠে ছুটে বাইরে চলে যায়। সবাই গা-টেপাটেপি করে বলে, “ইস, এখনই এত দরদ? এ যে দেখি দক্ষযজ্ঞের সতীকেও ছাড়িয়ে গেল।”

 বিপ্রদাসের মনের গতি হাল-আমলের, তবু জাত-কুলের হীনতায় তাকে কাবু করে। তাই, গুজবটা চাপা দেবার অনেক চেষ্টা করলে। কিন্তু ছেঁড়া বালিশে চাপ দিলে তার তুলাে যেমন আরও বেশি বেরিয়ে পড়ে, তেমনি হল।

 এদিকে বুড়ো প্রজা দামােদর বিশ্বাসের কাছে খবর পাওয়া গেল যে, বহুপূর্বে ঘােষালেরা নুরনগরের পাশের গ্রাম শেয়াকুলির মালেক ছিল। এখন সেটা চাটুজ্যেদের দখলে। ঠাকুর-বিসর্জনের মামলায় কী করে সবসুদ্ধ ঘােষালদেরও বিসর্জন ঘটেছিল, কী কৌশলে কর্তাবাবুরা, শুধু দেশছাড়া নয়, তাদের সমাজছাড়া করেছিলেন, তার বিবরণ বলতে বলতে দামোদরের মুখ ভক্তিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ঘোষালেরা এককালে ধনে মানে কুলে চাটুজ্যেদের সমকক্ষ ছিলেন এটা সুখবর, কিন্তু বিপ্রদাসের মনে ভয় লাগল যে, এই বিয়েটাও সেই পুরাতন মামলার একটা জের না কি?