যোগাযোগ/২৬

উইকিসংকলন থেকে

২৬

 পরদিন ভোরে যখন কুমু বিছানায় উঠে বসেছে তখন ওর স্বামী ঘুমোচ্ছ। কুমু তার মুখের দিকে চাইলে না, পাছে মন বিগড়ে যায়। অতি সাবধানে উঠে পায়ের কাছে প্রণাম করলে, তার পরে স্নান করবার ঘরে গেল। স্নান সারা হলে পর পিছন দিকের দরজা খুলে গিয়ে বসল ছাদে, কুয়াশার ভিতর দিয়ে পূর্ব-আকাশে একটা মলিন সোনার রেখা তখন দেখা দিয়েছে।

 বেলা হল, রোদ্দুর উঠল যখন, কুমু আস্তে আস্তে শোবার ঘরে ফিরে এসে দেখলে তার স্বামী তখন চলে গেছে। আয়নার দেরাজের উপর তার পুঁতির কাজ-করা থলিটি ছিল। তার মধ্যে দাদার টেলিগ্রামের কাগজটি রাখবার জন্যে সেটা খুলেই দেখতে পেলে সেই নীলার অংটি নেই।

 সকালবেলাকার মানসপূজার পর তার মুখে যে একটি শান্তির ভাব এসেছিল সেটা মিলিয়ে গিয়ে চোখে আগুন জ্বলে উঠল। কিছু মিষ্টি ও দুধ খাওয়াবে বলে ডাকতে এল মোতির মা। কুমুর মুখে জবাব নেই, যেন কঠিন পাথরের মূর্তি।

 মোতির মা ভয় পেয়ে পাশে এসে বসল— জিজ্ঞাসা করলে, “কী হয়েছে, ভাই?” কুমুর মুখে কথা বেরোল না, ঠোঁট কাপতে লাগল।

 “বলো, দিদি, আমাকে বলো, কোথায় তোমার বেজেছে?”

 কুমু রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বললে, “নিয়ে গেছে চুরি করে!”

 “কী নিয়ে গেছে দিদি?”

 “আমার আংটি, আমার দাদার আশীর্বাদী আংটি।”

 “কে নিয়ে গেছে?”

 কুমু উঠে দাঁড়িয়ে কারও নাম না করে বাইরের অভিমুখে ইঙ্গিত করলে।

 “শান্ত হও ভাই, ঠাট্টা করেছে তোমার সঙ্গে, আবার ফিরিয়ে দেবে।”

 “নেব না ফিরিয়ে— দেখব কত অত্যাচার করতে পারে ও!”

 “আচ্ছা, সে হবে পরে, এখন মুখে কিছু দেবে এস।”

 “না, পারব না; এখানকার খাবার গলা দিয়ে নাববে না।”

 “লক্ষ্মীটি ভাই, আমার খাতিরে খাও।”

 “একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, আজ থেকে আমার নিজের বলে কিছুই রইল না?”

 “না, রইল না। যা-কিছু রইল তা স্বামীর মর্জির উপরে। জান না চিঠিতে দাসী বলে দস্তখত করতে হবে।”

 দাসী! মনে পড়ল, রঘুবংশের ইন্দুমতীর কথা—

গৃহিণী সচিবঃ সখী মিথঃ
প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ—

ফর্দের মধ্যে দাসী তো কোথাও নেই। সত্যবানের সাবিত্রী কি দাসী? কিংবা উত্তররামচরিতের সীতা?

 কুমু বললে, “স্ত্রী যাদের দাসী তারা কোন্ জাতের লোক?”

 “ও-মানুষকে এখনও চেন নি। ও যে কেবল অন্যকে গোলামি করায় তা নয়, নিজের গোলামি নিজে করে। যেদিন আপিসে যেতে পারে না নিজের বরাদ্দ থেকে সেদিনকার টাকা কাটা পড়ে। একবার ব্যামো হয়ে এক মাসের বরাদ্দ বন্ধ ছিল, তার পরের দু-তিন মাস খাইখরচ পর্যন্ত কমিয়ে লোকসান পুষিয়ে নিয়েছে। এতদিন আমি ঘরকন্নার কাজ চালিয়ে আসছি সেই অনুসারে আমারও মাসহারা বরাদ্দ। আত্মীয় বলে ও কাউকে মানে না। এ-বাড়িতে কর্তা থেকে চাকর-চাকরানী পর্যন্ত সবাই গোলাম।”

 কুমু একটু চুপ করে থেকে বললে, “আমি সেই গোলামিই করব। আমার রোজকার খোরপোশ হিসেবমত রোজ রোজ শোধ করব। আমি এ-বাড়িতে বিনা মাইনের স্ত্রী বাঁদী হয়ে থাকব না। চলো, আমাকে কাজে ভরতি করে নেবে। ঘরকন্নার ভার তোমার উপরেই তো,—আমাকে তুমি তোমার অধীনে খাটিয়ে নিয়ো, আমাকে রানী বলে কেউ যেন ঠাট্টা না করে।”

 মোতির মা হেসে কুমুর চিবুক ধরে বললে, “তাহলে তো আমার কথা মানতে হবে। আমি হুকুম করছি; চলো এখন খেতে।”

 ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে কুমু বললে, “দেখো ভাই, নিজেকে দেব বলেই তৈরি হয়ে এসেছিলুম, কিন্তু ও কিছুতেই দিতে দিলে না। এখন দাসী নিয়েই থাকুক। আমাকে পাবে না।”

 মোতির মা বললে, “কাঠুরে গাছকে কাটতেই জানে, সে গাছ পায় কাঠ পায়। মালী গাছকে রাখতে জানে, সে পায় ফুল, পায় ফল। তুমি পড়েছ কাঠুরের হাতে, ও যে ব্যবসাদার। ওর মনে দরদ নেই কোথাও।”

 এক সময়ে শোবার ঘরে ফিরে এসে কুমু দেখলে, তার টিপাইয়ের উপর একশিশি লজেঞ্জস। হাবলু তার ত্যাগের অর্ঘ্য গোপনে নিবেদন করে নিজে কোথায় লুকিয়েছে। এখানে পাষাণের ফাঁক দিয়েও ফুল ফোটে। বালকের এই লজেঞ্জসের ভাষায় একসঙ্গে ওকে কাঁদালে হাসালে। তাকে খুঁজতে বেরিয়ে দেখে বাইরে সে দরজার আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মা তাকে এ ঘরে যাতায়াত করতে বারণ করেছিল। তার ভয় ছিল পাছে কোনো কিছু উপলক্ষ্যে কর্তার বিরক্তি ঘটে। মোটের উপরে, মধুসূদনের নিজের কাজ ছাড়া অন্য বাবদে তার কাছ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকাই নিরাপদ, এ-কথা এ-বাড়ির সবাই জানে।

 কুমু হাবলুকে ধরে ঘরে নিয়ে এসে কোলে বসালে। ওর গৃহসজ্জার মধ্যে পুতুল-জাতীয় যা-কিছু জিনিস ছিল সেইগুলো দুজনে নাড়াচাড়া করতে লাগল। কুমু বুঝতে পারলে একটা কাগজচাপা হাবলুর ভারি পছন্দ— কঁচের ভিতর দিয়ে রঙিন ফুল যে কী করে দেখা যাচ্ছে সেইটে বুঝতে না পেরে ওর ভারি তাক লেগেছে।

 কুমু বললে, “এটা নেবে গোপাল?”

 এতবড়ো অভাবনীয় প্রস্তাব ওর বয়সে কখনো শোনে নি। এমন জিনিসও কি ও কখনো আশা করতে পারে? বিস্ময়ে সংকোচে কুমুর মুখের দিকে নীরবে চেয়ে রইল।

 কুমু বললে, “এটা তুমি নিয়ে যাও।”

 হাবলু আহ্লাদ রাখতে পারলে না— সেটা হাতে নিয়েই লাফাতে লাফাতে ছুটে চলে গেল।

 সেইদিন বিকেলে হাবলুর মা এসে বললে, “তুমি করেছ কী ভাই? হাবলুর হাতে কাঁচের কাগজচাপা দেখে বড়ঠাকুর হুলস্থূল বাধিয়ে দিয়েছে। কেড়ে তে নিয়েইছে—— তার পর তাকে চোর বলে মার। ছেলেটাও এমনি, তোমার নামও করে নি। হাবলুকে আমিই যে জিনিসপত্র চুরি করতে শেখাচ্ছি এ-কথাও ক্রমে উঠবে!”

 কুমু কাঠের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে বসে রইল।

 এমন সময়ে বাইরে মচ মচ শব্দে মধুসূদন আসছে। মোতির মা তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল। মধুসূদন কাঁচের কাগজচাপা হাতে করে যথাস্থানে ধীরে ধীরে সেটা গুছিয়ে রাখলে। তার পরে নিশ্চিতপ্রত্যয়ের কণ্ঠে শান্ত গম্ভীর স্বরে বললে, “হাবলু তোমার ঘর থেকে এটা চুরি করে নিয়েছিল। জিনিসপত্র সাবধান করে রাখতে শিখো।”

 কুমু তীক্ষ্ণ স্বরে বললে, “ও চুরি করে নি।”

 “আচ্ছা, বেশ, তাহলে সরিয়ে নিয়েছে।”

 “না, আমিই ওকে দিয়েছি।”

 “এমনি করে ওর মাথা খেতে বসেছ বুঝি? একটা কথা মনে রেখো, আমার হুকুম ছাড়া জিনিসপত্র কাউকে দেওয়া চলবে না। আমি এলোমেলো কিছুই ভালোবাসি নে।”

 কুমু দাঁড়িয়ে উঠে বললে, “তুমি নাও নি আমার নীলার আংটি?”

 মধুসূদন বললে, “হাঁ নিয়েছি।”

 “তাতেও তোমার ওই কাঁচের ঢেলাটার দাম শোধ হল না?”

 “আমি তো বলেছিলুম, ওটা তুমি রাখতে পারবে না।”

 “তোমার জিনিস তুমি রাখতে পারবে, আর আমার জিনিস আমি রাখতে পারব না?”

 “এ-বাড়িতে তোমার স্বতন্ত্র জিনিস বলে কিছু নেই।”

 “কিছু নেই? তবে রইল তোমার এই ঘর পড়ে।”

 কুমু যেই গেছে, ব্যস্তসমস্ত হয়ে শ্যামা ঘরে প্রবেশ করে বললে, “বউ কোথায় গেল?”

 “কেন?”

 “সকাল থেকে ওর খাবার নিয়ে বসে আছি, এ-বাড়িতে এসে বউ কি খাওয়াও বন্ধ করবে?”

 “তা হয়েছে কী? নুরনগরের রাজকন্যা না হয় নাই খেলেন? তোমরা কি ওঁর বাঁদী নাকি।”

 “ছি ঠাকুরপো, ছেলেমানুষের উপর অমন রাগ করতে নেই। এমন না খেয়ে খেয়ে কাটাবে এ আমরা সহ্য করতে পারি নে। সাধে সেদিন মুর্ছো গিয়েছিল?”

 মধুসূদন গর্জন করে উঠল, “কিছু করতে হবে না, যাও চলে! খিদে পেলে আপনিই খাবে।”

 শ্যামা যেন অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে চলে গেল।

 মধুসূদনের মাথায় রক্ত চড়তে লাগল। দ্রুতবেগে নাবার ঘরে জলের ঝাঁঝরি খুলে দিয়ে তার নিচে মাথা পেতে দিলে।