যোগাযোগ/৩৪

উইকিসংকলন থেকে
◄  ৩৩
৩৫  ►

৩৪

 কুমুর পালাবার একটিমাত্র জায়গা আছে-এ-বাড়ির ছাদ। সেইখানে চলে গেল। বেলা হয়েছে, প্রখর রৌদ্রে ছাদ ভরে গেছে, কেবল প্রাচীরের গায়ে এক জায়গায় একটুখানি ছায়া। সেইখানে গিয়ে বসল। একটি গান মনে পড়ল, তার সুরটি আসাবরী। সে গানের আরম্ভটি হচ্ছে, “বাঁশরী হমারি রে”—কিন্তু বাকিটুকু ওস্তাদের মুখে মুখে বিকৃত বাণী— তার মানে বুঝতে পারা যায় না। কুমু ওই অসম্পূর্ণ অংশ আপন ইচ্ছামতো নূতন নূতন তান দিয়ে ভরিয়ে পালটে পালটে গাইতে লাগল। ওই একটুখানি কথা অর্থে ভরে উঠল। ওই বাক্যটি যেন বলছে, “ও আমার বাঁশি, তোমাতে সুর ভরে উঠছে না কেন? অন্ধকার পেরিয়ে পৌঁচচ্ছে না কেন যেখানে দুয়ার রুদ্ধ, যেখানে ঘুম ভাঙল না? বাঁশরী হমারি রে, বাঁশরী হমারি রে!”

 মোতির মা যখন এসে বললে “চলো ভাই, খেতে যাবে” তখন সেই ছাদের কোণের একটুখানি ছায়া গেছে লুপ্ত হয়ে, কিন্তু তখন ওর মন সুরে ভরপুর, সংসারে কে ওর ’পরে কী অন্যায় করেছে সে-সমস্ত তুচ্ছ হয়ে গেছে। ওর চিঠি নিয়ে মধুসূদনের যে ক্ষুদ্রতা, যে-ক্ষুদ্রতায় ওর মনে তীব্র অবজ্ঞা উদ্যত হয়ে উঠেছিল, সে যেন এই রোদ-ভরা আকাশে একটা পতঙ্গের মতো কোথায় বিলীন হয়ে গেল, তার ক্রুদ্ধ গুঞ্জন মিলিয়ে গেল অসীম আকাশে। কিন্তু চিঠির মধ্যে দাদার যে স্নেহবাক্য আছে সেটুকু পাবার জন্যে তার মনের আগ্রহ তো যায় না।

 ওই ব্যাগ্রতাটা তার মনে লেগে রইল। খাওয়া হয়ে গেলে আর সে থাকতে পারলে না। মোতির মাকে বললে, “আমি যাই বাইরের ঘরে, চিঠি প’ড়ে আসি।”

 মোতির মা বললে, “আর একটু দেরি হোক, চাকররা সবাই যখন ছুটি নিয়ে খেতে যাবে তখন যেয়ো।”

 কুমু বললে, “না না, সে বড় চুরি করে যাওয়ার মতো হবে। আমি সকলের সামনে দিয়ে যেতে চাই, তাতে যে যা মনে করে করুক।”

 মোতির মা বললে, “তাহলে চলো আমিও সঙ্গে যাই।”

 কুমু বলে উঠল, “না, সে কিছুতেই হবে না। তুমি কেবল বলে দাও কোন্ দিক দিয়ে যেতে হবে।”

 মোতির মা অন্তঃপুরের ঝরকা-দেওয়া বারান্দা দিয়ে ঘরটা দেখিয়ে দিলে। কুমু বেরিয়ে এল। ভৃত্যেরা সচকিত হয়ে উঠে তাকে প্রণাম করলে। কুমু ঘরে ঢুকে ডেস্কের দেরাজ খুলে দেখলে তার চিঠি। তুলে নিয়ে দেখলে লেফাফা খোলা। বুকের ভিতরটা ফুলে উঠতে লাগল, একেবারে অসহ্য হয়ে উঠল। যে-বাড়িতে কুমু মানুষ হয়েছে সেখানে এ-রকম অবমাননা কোনোমতেই কল্পনা পর্যন্ত করা যেত না। নিজের আবেগের এই তীব্র প্রবণতাতেই তাকে ধাক্কা মেরে সচেতন করে তুলল। সে বলে উঠল, “প্রিয়ঃ প্রিয়ায়ার্হসি দেব সোঢ়ুম্”—তবু তুফান থামে না—তাই বার বার বললে। বাইরে যে আরদালি ছিল, আপিস-ঘরে তাদের বউরানীর এই আপন-মনে মন্ত্র-আবৃত্তি শুনে সে অবাক হয়ে গেল। অনেকক্ষণ বলতে বলতে কুমুর মন শান্ত হয়ে এল। তখন চিঠিখানি সামনে রেখে চৌকিতে বসে হাত জোড় করে স্থির হয়ে রইল। চিঠি সে চুরি করে পড়বে না এই তার পণ।

 এমন সময় মধুসূদন ঘরে ঢুকেই চমকে উঠে দাঁড়াল—কুমু তার দিকে চাইলেও না। কাছে এসে দেখলে, ডেস্কের উপর সেই চিঠি। জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি এখানে যে!”

 কুমু নীরবে শান্তদৃষ্টিতে মধুসূদনের মুখের দিকে চাইলে। তার মধ্যে নালিশ ছিল না। মধুসূদন আবার জিজ্ঞাসা করলে, “এ-ঘরে তুমি কেন?”

 এই বাহুল্যপ্রশ্নে কুমু অধৈর্যের স্বরেই বললে, “আমার নামে দাদার চিঠি এসেছে কি না তাই দেখতে এসেছিলেম।”

 সে-কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করলে না কেন, এমনতরো প্রশ্নের রাস্তা কাল রাত্তিরে মধুসূদন আপনি বন্ধ করে দিয়েছে। তাই বললে, “এ-চিঠি আমিই তোমার কাছে নিয়ে যাচ্ছিলুম, সে-জন্যে তোমার এখানে আসবার তো দরকার ছিল না।”

 কুমু একটুখানি চুপ করে রইল, মনকে শান্ত করে তার পরে বললে, “এ-চিঠি তুমি আমাকে পড়তে দিতে ইচ্ছে কর নি, সেইজন্যে এ-চিঠি আমি পড়ব না। এই আমি ছিঁড়ে ফেললুম। কিন্তু এমন কষ্ট আমাকে আর কখনো দিয়ো না। এর চেয়ে কষ্ট আমার আর কিছু হতে পারে না।”

 এই বলে সে মুখে কাপড় দিয়ে ছুটে বেরিয়ে চলে গেল।

 ইতিপূর্বে আজ মধ্যাহ্নে আহারের পর মধুসূদনের মনটা আলোড়িত হয়ে উঠছিল। আন্দোলন কিছুতে থামাতে পারছিল না। কুমুর খাওয়া হলেই তাকে ডাকিয়ে পাঠাবে বলে ঠিক করে রেখেছে। আজ সে মাথার চুল আঁচড়ানো সম্বন্ধে একটু বিশেষ যত্ন নিলে। আজ সকালেই একটি ইংরেজ নাপিতের দোকান থেকে স্পিরিট-মেশানো সুগন্ধি কেশতৈল ও দামি এসেন্স কিনিয়ে আনিয়েছিল। জীবনে এই প্রথম সেগুলি সে ব্যবহার করেছে। সুগন্ধি ও সুসজ্জিত হয়ে সে প্রস্তুত ছিল। আপিসের সময় আজ অন্তত পঁয়তাল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেল।

 সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেতেই মধুসূদন চমকে উঠে বসল। হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে একখানা পুরোনো খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের পাতাটা নিয়ে এমনভাবে সেটাকে দেখতে লাগল যেন তার আপিসেরই কাজের অঙ্গ। এমনকি পকেট থেকে একটা মোটা নীল পেন্সিল বের করে দুটো-একটা দাগ ও টেনে দিলে।

 এমন সময় ঘরে প্রবেশ করলে শ্যামাসুন্দরী। ভ্রূকুঞ্চিত করে মধুসূদন তার মুখের দিকে চাইলে। শ্যামাসুন্দরী বললে, “তুমি এখানে বসে আছ, বউ যে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।”

 “খুঁজে বেড়াচ্ছে! কোথায়?”

 “এই যে দেখলুম, বাইরে তোমার আপিস-ঘরে গিয়ে ঢুকল। তা এতে অত আশ্চর্য হচ্ছ কেন ঠাকুরপো—সে ভেবেছে তুমি বুঝি—”

 তাড়াতাড়ি মধুসূদন বাইরে চলে গেল। তার পরেই সেই চিঠির ব্যাপার।

 পালের নৌকায় হঠাৎ পাল ফেটে গেলে তার যে-দশা মধুসূদনের তাই হল। তখন আর দেরি করবার লেশমাত্র অবকাশ ছিল না। আপিসে চলে গেল। কিন্তু সকল কাজের ভিতরে ভিতরে তার অসম্পূর্ণ ভাঙা চিন্তার তীক্ষ্ণ ধারগুলাে কেবলই যেন ঠেলে ঠেলে বিঁধে বিঁধে উঠছে। এই মানসিক ভূমিকম্পের মধ্যে মনােযােগ দিয়ে কাজ করা সেদিন তার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। আপিসে জানিয়ে দিলে, উৎকট মাথা ধরেছে, কার্যশেষের অনেক আগেই বাড়ি ফিরে এল।