পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (সপ্তম সম্ভার).djvu/২২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গৃহদাই ইরমা একবারমাত্র মুখ তুলিয়াই আবার তেমনি করিয়া টেবিলের উপর মাথা রাখিল । তাহার মুখ মড়ার মত শাদী, দুই চোখের কোলে গাঢ় কালিমা এবং কালে পাথরের গা দিয়া যেমন ঝরণার ধারা নামিয়া আসে, ঠিক যেমনি দুই চোখের কোল বাহিয়া অশ্র ঝরিতেছে। বৃদ্ধ শুধু একটা অফুট শব্দ করিয়া একদৃষ্টি ওই অৰ্দ্ধমৃত নারী-দেহের প্রতি নিঃশব্দে চাহিয়া বুহিলেন, কোন কথাই তাহার কণ্ঠ ভেদিয়া বাহির হইতে পারিল না । مob\ সকালবেলা দুটিখানি গরম মুড়ি দিয়া চা-খাওয়া শেষ করিয়া কেদারবাবু একটা পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিলেন । উচ্ছিষ্ট বাসনগুলি লইতে মৃণাল ঘরে ঢুকিতেই কহিলেন, মা, তোমার এই গরম মুড়ি আর পাথরের বাটির চা’র ভেতরে যে কি অমৃত আছে জানিনে, কিন্তু এই একটা মাসের মধ্যে আর নড়তে পারলুম না । অচলার সম্পর্কে মৃণাল উহাকে বাবা বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছিল। কহিল, কেন তুমি পালাবার জন্যে এত ব্যস্ত হও বাবা, তোমার এ—আমি কি সেবা করিতে জানিনে ? তোমার এ মেয়ে কি-এই কথাটাই মৃণাল অসাবধানে বলিতে গিয়াছিল ? কিন্তু চাপিয়া গিয়া অন্য প্রকারে প্রকাশ করিল। তাই বোধ করি, এ ইঙ্গিত কেদারবাবু বুঝিয়াও বুঝিতে চাহিলেন না । কিন্তু কণ্ঠস্বর তাহার সহসা করুণ হইয়া উঠিল, বলিলেন, কৈ আর পালাতে ব্যস্ত হই মা ! তোমার তৈরি চা, তোমার হাতের রায়, তোমার এই মাটির ঘরখানি ছেড়ে আমার স্বর্গে যেতেও ইচ্ছা করে না । ওই ছোট্ট জানালার ধারটিতে বসে আমি কতদিন ভাবি মৃণাল, আরো দুটো বৎসর যদি ভগবানের দয়ায় বঁাচতে পাই ত কলকাতার মধ্যে থেকে সারাজীবন ধরে যত ক্ষতি নিজে করেচি, তার সবটুকু পূরণ করে নেব। আর সেই মূলধনটুকু হাতে নিয়েই যেন একদিন তার কাছে গিয়ে দাড়াতে পারি । কত বড় বেদনার ভিতর দিয়া তিনি এই কথাগুলি বলিলেন এবং কিরূপ মর্শাস্তিক লঙ্গায় কলিকাতার আজন্মপরিচিত পল্পী ও বাসভবন ছাড়িয়া, চিরদিনের আশ্রিতসমাজ ত্যাগ করিয়া এই বনের মধ্যে পর্ণকুটিরে বাকী দিনগুলা কাটাইবার অভিলাষ ব্যক্ত করিলেন, মৃণাল তাহ বুঝিল, এবং সেইজন্যই কোন উত্তর না দিয়া চায়ের বাটিটা হাতে লইয়া ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল। - 总》伞