জাপান-যাত্রী/৯

উইকিসংকলন থেকে

 ২রা জ্যৈষ্ঠে আমাদের জাহাজ সিঙাপুরে এসে পৌঁছিল। অনতিকাল পরেই একজন জাপানী যুবক আমার সঙ্গে দেখা কর্‌তে এলেন; তিনি এখানকার একটি জাপানী কাগজের সম্পাদক। তিনি আমাকে বল্লেন, তাঁদের জাপানের সব চেয়ে বড় দৈনিক পত্রের সম্পাদকের কাছ থেকে তাঁরা তার পেয়েছেন যে আমি জাপানে যাচ্চি, সেই সম্পাদক আমার কাছ থেকে একটি বক্তৃতা আদায় কর্‌বার জন্যে অনুরোধ করেছেন। আমি বল্লুম, জাপানে না পৌঁছে আমি এ বিষয়ে আমার সম্মতি জানাতে পারব না। তখনকার মত এই টুকুতেই মিটে গেল। আমাদের যুবক ইংরেজ বন্ধু পিয়ার্সন এবং মুকুল সহর দেখ্‌তে বেরিয়ে গেলেন। জাহাজ একেবারে ঘাটে লেগেচে। এই জাহাজের ঘাটের চেয়ে কুশ্রী বিভীষিকা আর নেই—এরি মধ্যে ঘন মেঘ করে বাদলা দেখা দিলে। বিকট ঘড়ঘড় শব্দে জাহাজ থেকে মাল ওঠানো নাবানো চল্‌তে লাগ্‌ল। আমি কুঁড়ে মানুষ, কোমর বেঁধে সহর দেখ্‌তে বেরনো আমার ধাতে নেই। আমি সেই বিষম গোলমালের সাইক্লোনের মধ্যে ডেক্-এ বসে মনকে কোনোমতে শান্ত করে রাখবার জন্যে লিখ্‌তে বসে গেলুম।

 খানিক বাদে কাপ্তেন এসে খবর দিলেন যে, একজন জাপানী মহিলা আমার সঙ্গে দেখা কর্‌তে চান। আমি লেখা বন্ধ করে একটি ইংবাজি-বেশ-পরা জাপানী মহিলার সঙ্গে আলাপে প্রবৃত্ত হলুম। তিনিও সেই জাপানী সম্পাদকের পক্ষ নিয়ে, বক্তৃতা করবার জন্যে আমাকে অনুরোধ কর্‌তে লাগলেন। আমি বহু কষ্টে সে অনুরোধ কাটালুম। তখন তিনি বল্লেন, আপনি যদি একটু সহর বেড়িয়ে আস্‌তে ইচ্ছা করেন ত আপনাকে সব দেখিয়ে আনতে পারি। তখন সেই বস্তা তোলার নিরন্তর শব্দ আমার মনটাকে জাঁতার মত পিস্‌ছিল, কোথাও পালাতে পারলে বাঁচি,―সুতরাং আমাকে বেশী পীড়াপীড়ি কর্‌তে হল না। সেই মহিলাটির মোটর গাড়িতে করে, সহর ছাড়িয়ে ররার গাছের আবাদের ভিতর দিয়ে, উঁচু নীচু পাহাড়ের পথে অনেকটা দূর ঘুরে এলুম। জমি ঢেউ-খেলানো, ঘাস ঘন সবুজ, রাস্তার পাশ দিয়ে একটি ঘোলা জলের স্রোত কল্‌কল্‌ করে এঁকে বেঁকে ছুটে চলেছে, জলের মাঝে মাঝে আঁটিবাঁধা কাটা বেত ভিজ্‌ছে। রাস্তার দুই ধারে সব বাগানবাড়ী। পথে ঘাটে চীনেই বেশী—এখানকার সকল কাজেই তারা আছে।

 গাড়ি সহরের মধ্যে যখন এল, মহিলাটি তাঁর জাপানী জিনিষের দোকানে আমাকে নিয়ে গেলেন। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেচে, মনে মনে ভাবচি জাহাজে আমাদের সন্ধ্যাবেলাকার খাবার সময় হয়ে এল; কিন্তু সেখানে সেই শব্দের ঝড়ে বস্তা তোলপাড় কর্‌চে কল্পনা করে, কোন মতেই ফির্‌তে মন লাগ্‌ছিল না। মহিলাটি একটি ছোট ঘরের মধ্যে বসিয়ে, আমাকে ও আমার সঙ্গী ইংরাজটিকে থালায় ফল সাজিয়ে খেতে অনুরোেধ করলেন। ফল খাওয়া হলে পর তিনি আস্তে আস্তে অনুরোধ করলেন, যদি আপত্তি না থাকে তিনি আমাদের হোটেলে খাইয়ে আনতে ইচ্ছা করেন। তাঁর এ অনুরোধও আমরা লঙ্ঘন করি নি। রাত্রি প্রায় দশটার সময় তিনি আমাদের জাহাজে পৌঁছিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে গেলেন।

 এই রমণীর ইতিহাসে কিছু বিশেষত্ব আছে। এঁর স্বামী জাপানে আইনব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু সে ব্যবসায় যথেষ্ট লাভজনক ছিল না। তাই আয়ব্যয়ের সামঞ্জস্য হওয়া কঠিন হয়ে উঠ্‌ছিল। স্ত্রীই স্বামীকে প্রস্তাব করলেন, এস আমরা একটা কিছু ব্যবসা করি। স্বামী প্রথমে তাতে নারাজ ছিলেন। তিনি বল্লেন, আমাদের বংশে ব্যবসা ত কেউ করে নি, ওটা আমাদের পক্ষে একটা হীন কাজ। শেষকালে স্ত্রীর অনুরোধে রাজি হয়ে, জাপান থেকে দুজনে মিলে সিঙাপুরে এসে দোকান খুল্‌লেন। সে আজ আঠারো বৎসর হল। আত্মীয়বন্ধু সকলেই একবাক্যে বল্লে, এইবার এরা মজ্‌ল। এই স্ত্রীলোকটির পরিশ্রমে, নৈপুণ্যে এবং লোকের সঙ্গে ব্যবহার-কুশলতায়, ক্রমশই ব্যবসায়ের উন্নতি হতে লাগ্‌ল। গত বৎসরে এঁর স্বামীর মৃত্যু হয়েছে—এখন এঁকে একলাই সমস্ত কাজ চালাতে হচ্চে।

 বস্তুত এই ব্যবসাটি এই স্ত্রীলোকেরই নিজের হাতে তৈরি। আমি যে কথা বল্‌ছিলুম, এই ব্যবসায়ে তারই প্রমাণ দেখ্‌তে পাই। মানুষের মন বোঝা এবং মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ রক্ষা করা স্ত্রীলোকের স্বভাবসিদ্ধ—এই মেয়েটির মধ্যে আমরাই তার পরিচয় পেয়েছি। তারপরে কর্ম্মকুশলতা মেয়েদের স্বাভাবিক। পুরুষ স্বভাবত কুঁড়ে, দায়ে পড়ে তাদের কাজ কর্‌তে হয়। মেয়েদের মধ্যে একটা প্রাণের প্রাচুর্য্য আছে, যার স্বাভাবিক বিকাশ হচ্চে কর্ম্মপরতা। কর্ম্মের সমস্ত খুঁটিনাটি যে কেবল ওরা সহ্য কর্‌তে পারে, তা নয়—তাতে ওরা আনন্দ পায়। তা ছাড়া দেনাপাওনা সম্বন্ধে ওরা সাবধানী। এই জন্যে, যে সব কাজে দৈহিক বা মানসিক সাহসিকতার দরকার হয় না, সে সব কাজ মেয়েরা পুরুষের চেয়ে ঢের ভাল করে কর্‌তে পারে, এই আমার বিশ্বাস। স্বামী যেখানে সংসার ছারখার করেছে, সেখানে স্বামীর অবর্ত্তমানে স্ত্রীর হাতে সংসার পড়ে সমস্ত সুশৃঙ্খলায় রক্ষা পেয়েচে, আমাদের দেশে তার বিস্তর প্রমাণ আছে; শুনেছি ফ্রান্সের মেয়েরাও ব্যবসায়ে আপনাদের কর্ম্মনৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েচে। যে সব কাজে উদ্ভাবনার দরকার নেই, যে সব কাজে পটুতা, পরিশ্রম, ও লোকের সঙ্গে ব্যবহারই সব চেয়ে দরকার, সে সব কাজ মেয়েদের।

 ৩রা জ্যৈষ্ঠ সকালে আমাদের জাহাজ ছাড়লে। ঠিক এই ছাড়বার সময় একটি বিড়াল জলের মধ্যে পড়ে’ গেল। তখন সমস্ত ব্যস্ততা ঘুচে গিয়ে, ঐ বিড়ালকে বাঁচানই প্রধান কাজ হয়ে উঠ্‌ল। নানা উপায়ে নানা কৌশলে তাকে জল থেকে উঠিয়ে তবে জাহাজ ছাড়লে। এতে জাহাজ ছাড়ার নির্দ্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেল। এইটিতে আমাকে বড় আনন্দ দিয়েছে।

 চীন সমুদ্র

 তোসা-মারু জাহাজ

 ৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৩।