জাপান-যাত্রী/১০

উইকিসংকলন থেকে

১০

 সমুদ্রের উপর দিয়ে আমাদের দিনগুলি ভেসে চলেচে, পালের নৌকার মত। সে নৌকা কোনো ঘাটে যাবার নৌকা নয়, তাতে কোনো বোঝাই নেই। কেবলমাত্র ঢেউয়ের সঙ্গে, বাতাসের সঙ্গে, আকাশের সঙ্গে কোলাকুলি করতে তারা বেরিয়েচে। মানুষের লোকালয় মানুষের বিশ্বের প্রতিদ্বন্দ্বী। সেই লোকালয়ের দাবী মিটিয়ে সময় পাওয়া যায় না, বিশ্বের নিমন্ত্রণ আর রাখ্‌তে পারিনে। চাঁদ যেমন তার একটা মুখ সূর্য্যের দিকে ফিরিয়ে রেখেছে, তার আর একটা মুখ অন্ধকার― তেমনি লোকালয়ের প্রচণ্ড টানে মানুষের সেই দিকের পিঠটাতেই চেতনার সমস্ত আলো খেলচে, অন্য একটা এদিক আমরা ভুলেই গেচি; বিশ্ব যে মানুষের কতখানি, সে আমাদের খেয়ালেই আসে না।

 সত্যকে যেদিকে ভুলি, কেবল যে সেই দিকেই লোকসান, তা নয়—সে লোকসান সকল দিকেই। বিশ্বকে মানুষ যে পরিমাণে যতখানি বাদ দিয়ে চলে, তার লোকসানের তাপ এবং কলুষ সেই পরিমাণে ততখানি বেড়ে ওঠে। সেই জন্যেই ক্ষণে ক্ষণে মানুষের একেবারে উল্টোদিকে টান আসে। সে বলে “বৈরাগ্যমেবাভয়ং”—বৈরাগ্যের কোনো বালাই নেই। সে বলে’ বসে, সংসার কারাগার; মুক্তি খুঁজতে শান্তি খুঁজতে সে বনে, পর্ব্বতে, সমুদ্রতীরে ছুটে যায়। মানুষ সংসারের সঙ্গে বিশ্বের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে বলেই, বড় করে প্রাণের নিঃশ্বাস নেবার জন্যে তাকে সংসার ছেড়ে বিশ্বের দিকে যেতে হয়। এত বড় অদ্ভুত কথা তাই মানুষকে বল্‌তে হয়েছে—মানুষের মুক্তির রাস্তা মানুষের কাছ থেকে দূরে।

 লোকালয়ের মধ্যে যখন থাকি, অবকাশ জিনিষটাকে তখন ডরাই। কেননা লোকালয় জিনিষটা একটা নিরেট জিনিষ, তার মধ্যে ফাঁক মাত্রই ফাঁকা। সেই ফাঁকাটাকে কোন মতে চাপা দেবার জন্যে আমাদের মদ চাই, তাস পাশা চাই, রাজা উজির মারা চাই—নইলে সময় কাটে না। অর্থাৎ সময়টাকে আমরা চাইনে, সময়টাকে আমরা বাদ দিতে চাই।

 কিন্তু অবকাশ হচ্চে বিরাটের সিংহাসন। অসীম অবকাশের মধ্যে বিশ্বের প্রতিষ্ঠা। বৃহৎ যেখানে আছে, অবকাশ সেখানে ফাঁকা নয়,― একেবারে পরিপূর্ণ। সংসারের মধ্যে যেখানে বৃহৎকে আমরা রাখিনি, সেখানে অবকাশ এমন ফাঁকা; বিশ্বে যেখানে বৃহৎ বিরাজমান, সেখানে অবকাশ এমন গভীর ভাবে মনোহর। গায়ে কাপড় না থাক্‌লে মানুষের যেমন লজ্জা সংসারে অবকাশ আমাদের তেমনি লজ্জা দেয়, কেননা, ওটা কিনা শূন্য, তাই ওকে আমরা বলি জড়তা, আলস্য;—কিন্তু সত্যকার সন্ন্যাসীর পক্ষে অবকাশে লজ্জা নেই, কেননা তার অবকাশ পূর্ণতা,―সেখানে উলঙ্গতা নেই।

 এ কেমনতর—যেমন প্রবন্ধ এবং গান। প্রবন্ধে কথা যেখানে থামে, সেখানে কেবলমাত্র ফাঁকা। গানে কথা যেখানে থামে, সেখানে সুরে ভরাট। বস্তুত সুর যতই বৃহৎ হয়, ততই কথার অবকাশ বেশী থাকা চাই। গায়কের সার্থকতা কথার ফাঁকে, লেখকের সার্থকতা কথার ঝাঁকে!

 আমরা লোকালয়ের মানুষ এই যে জাহাজে করে চলচি, এইবার আমরা কিছুদিনের জন্যে বিশ্বের দিকে মুখ ফেরাতে পেরেচি। সৃষ্টির যে-পিঠে অনেকের ঠেলাঠেলি ভিড়, সেদিক থেকে যে-পিঠে একের আসন, সেদিকে এসেচি। দেখতে পাচ্চি, এই যে নীল আকাশ এবং নীল সমুদ্রের বিপুল অবকাশ― এ যেন অমৃতের পূর্ণ ঘট।

 অমৃত,—সে যে শুভ্র আলোর মত পরিপূর্ণ‌ এক। শুভ্র আলোয় বহুবর্ণচ্ছটা একে মিলেচে, অমৃতরসে তেমনি বহু রস একে নিবিড়। জগতে এই এক আলো যেমন নানাবর্ণে বিচিত্র, সংসারে তেমনি এই এক রসই নানা রসে বিভক্ত। এই জন্যে, অনেককে সত্য করে জান্‌তে হলে, সেই এককে সঙ্গে সঙ্গে জান্‌তে হয়। গাছ থেকে যে ডাল কাটা হয়েচে, সে ডালের ভার মানুষকে বইতে হয়, গাছে যে ডাল আছে সে ডাল মানুষের ভার বইতে পারে। এক থেকে বিচ্ছিন্ন যে অনেক, তারই ভার মানুষের পক্ষে বোঝা,―একের মধ্যে বিধৃত যে অনেক, সেই ত মানুষকে সম্পূর্ণ আশ্রয় দিতে পারে।

 সংসারে একদিকে আবশ্যকের ভিড়, অন্যদিকে অনাবশ্যকের। আবশ্যকের দায় আমাদের বহন কর্‌তেই হবে, তাতে আপত্তি করলে চল্‌বে না। যেমন ঘরে থাক্‌তে হলে দেয়াল না হলে চলে না,―এও তেমনি। কি সবটাই ত দেয়াল নয়। অন্তত খানিকটা করে জানালা থাকে—সেই ফাঁক দিয়ে আমরা আকাশের সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা কবি। কিন্তু সংসারে দেখ্‌তে পাই লোকে ঐ জানালাটুকু সইতে পারে না। ঐ ফাঁকটুকু ভরিয়ে দেবার জন্যে যতরকম সাংসারিক অনাবশ্যকের সৃষ্টি। ঐ জানলাটার উপর বাজে কাজ, বাজে চিঠি, বাজে সভা, বাজে বক্তৃতা, বাজে হাঁস্‌ফাঁস্‌ মেরে দিয়ে, দশে মিলে ঐ ফাঁকটাকে একেবারে বুজিয়ে ফেলা হয়। নারকেলের ছিব্‌ড়ের মত, এই অনাবশ্যকের পরিমাণটাই বেশী। ঘরে, বাইরে, ধর্ম্মে, কর্ম্মে, আমােদে, আহ্লাদে, সকল বিষয়েই এরই অধিকার সব চেয়ে বড়— এর কাজই হচ্চে ফাঁক বুজিয়ে বেড়ানো।

 কিন্তু কথা ছিল ফাঁক বোজাব না, কেননা ফাঁকের ভিতর দিয়ে ছাড়া পূর্ণকে পাওয়া যায় না। ফাঁকের ভিতর দিয়েই আলো আসে, হাওয়া আসে। কিন্তু আলো হাওয়া আকাশ যে মানুষের তৈরি জিনিষ নয়, তাই লােকালয় পারৎপক্ষে তাদের জন্যে জায়গা রাখতে চায় না—তাই আবশ্যক বাদে যেটুকু নিরালা থাকে, সেটুকু অনাবশ্যক দিয়ে ঠেসে ভর্ত্তি করে দেয়। এম্‌নি করে মানুষ আপনার দিনগুলোকে ত নিরেট করে তুলেইচে, রাত্রিটাকেও যতখানি পারে ভরাট করে দেয়। ঠিক যেন কলকাতার ম্যুনিসিপালিটির আইন। যেখানে যত পুকুর আছে বুজিয়ে ফেল্‌তে হবে,—রাবিশ দিয়ে হোক্, যেমন করে হােক্। এমন কি, গঙ্গাকেও যতখানি পারা যায় পুল-চাপা, জেটি-চাপা, জাহাজ-চাপা দিয়ে গলা টিপে মারবার চেষ্টা। ছেলেবেলাকার কল্‌কাতা মনে পড়ে, ঐ পুকুরগুলােই ছিল আকাশের স্যাঙাৎ, সহরের মধ্যে ঐখানটাতে দ্যুলােক এই ভূলােকে একটুখানি পা ফেলবার জায়গা পেত, ঐখানেই আকাশের আলােকের আতিথ্য কর্‌বার জন্য পৃথিবী আপন জলের আসনগুলি পেতে রেখেছিল।

 আবশ্যকের একটা সুবিধা এই যে, তার একটা সীমা আছে। সে সম্পূর্ণ বেতালা হতে পারে না, সে দশটা-চারটেকে স্বীকার করে, তার পার্ব্বণের ছুটি আছে, সে রবিবারকে মানে, পারৎপক্ষে রাত্রিকে সে ইলেক্‌ট্রিক্ লাইট্ দিয়ে একেবারে হেসে উড়িয়ে দিতে চায় না। কেননা, সে যেটুকু সময় নেয়, আয়ু দিয়ে অর্থ দিয়ে তার দাম চুকিয়ে দিতে হয়—সহজে কেউ তার অপব্যয় কর্‌তে পারে না। কিন্তু অনাবশ্যকের তালমানের বোধ নেই, সে সময়কে উড়িয়ে দেয়, অসময়কে টিঁক্‌তে দেয় না। সে সদর রাস্তা দিয়ে ঢোকে, খিড়কির রাস্তা দিয়ে ঢোকে আবার জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে। সে কাজের সময় দরজায় ঘা মারে, ছুটির সময় হুড়্‌মুড়্‌ করে আসে, রাত্রে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। তার কাজ নেই বলেই তার ব্যস্ততা আরো বেশী।

 আবশ্যক কাজের পরিমাণ আছে, অনাবশ্যক কাজের পরিমাণ নেই—এইজন্যে অপরিমেয়ের আসনটি ঐ লক্ষীছাড়াই জুড়ে বসে, ওকে ঠেলে ওঠানো দায় হয়। তখনই মনে হয় দেশ ছেড়ে পালাই, সন্ন্যাসী হয়ে বেরই, সংসারে আর টেঁকা যায় না!

 যাক্, যেমনি বেরিয়ে পড়েচি, অমনি বুঝতে পেরেচি বিরাট বিশ্বের সঙ্গে আমাদের যে আনন্দের সম্বন্ধ, সেটাকে দিনরাত অস্বীকার করে কোনো বাহাদুরি নেই। এই যে ঠেলাঠেলি ঠেলাঠেসি নেই, অথচ সমস্ত কানায় কানায় ভরা, এইখানকার দর্পণটিতে যেন নিজের মুখের ছায়া দেখ্‌তে পেলুম। “আমি আছি” এই কথাটা গলির মধ্যে, ঘরবাড়ীর মধ্যে ভারি ভেঙে চুরে বিকৃত হয়ে দেখা দেয়। এই কথাটাকে এই সমুদ্রের উপর, আকাশের উপর সম্পূর্ণ ছড়িয়ে দিয়ে দেখ্‌লে তবে তার মানে বুঝতে পারি―তখন আবশ্যককে ছাড়িয়ে, অনাবশ্যককে পেরিয়ে আনন্দলোকে তার অভ্যর্থনা দেখ্‌তে পাই,— তখন স্পষ্ট করে বুঝি, ঋষি কেন মানুষদের অমৃতস্য পুত্রাঃ বলে আহ্বান করে ছিলেন।