বিশ্বপরিচয়/গ্রহলোক

উইকিসংকলন থেকে
গ্রহলোক

 গ্রহ কাকে বলে সে-কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। সূর্য হেলো নক্ষত্র, পৃথিবী হোলো গ্রহ, সূর্য থেকে ছিড়ে-পড়া টুকরা, ঠাণ্ডা হয়ে তার আলো গেছে নিবে। কোননা গ্রহেরই আপন আলো নেই। সূর্যের চারদিকে এই গ্রহদের প্রত্যেকের নির্দিষ্ট পথ ডিম্বরেখাকারে, কারো বা পথ সূর্যের কাছে, কারো বা পথ সূর্য থেকে বহুদূরে। সূর্যকে ঘুরে আসতে কোনো গ্রহের এক বছরের কম লাগে, কারো বা একশো বছরের বেশি। যে গ্রহেরই ঘুরতে যত সময় লাগুক এই ঘোরার সম্বন্ধে একটি বাঁধা নিয়ম আছে তার কখনই ব্যতিক্রম হয় না। সূর্যপরিবারের দূর বা কাছের ছোটো বা বড়ো সকল গ্রহকেই পশ্চিম দিক থেকে পুব দিকে প্রদক্ষিণ করতে হয়। এর থেকে বোঝা যায় গ্রহেরা সূর্য থেকে একই অভিমুখে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়েছে, তাই চলবার ঝোঁক হয়েছে একই দিকে। চলতি গাড়ি থেকে নেবে পড়বার সময় গাড়ি যে মুখে চলেছে সেইদিকে শরীরের উপর একটা ঝোঁক আসে। গাড়ি থেকে পাঁচজন নামলে পাঁচজনেরই সেই একদিকে হবে ঝোঁক। তেমনি ঘূর্ণমান সূর্য থেকে বেরিয়ে পড়বার সময় সব গ্রহই একই দিকে ঝোঁক পেয়েছে। ওদের এই চলার প্রবৃত্তি থেকে ধরা পড়ে ওরা সবাই একজাতের, সবাই একঝোঁকা।

 সূর্যের সবচেয়ে কাছে আছে বুধগ্রহ, ইংরেজিতে যাকে বলে মার্করি। সে সূর্য থেকে সাড়ে তিন কোটি মাইল মাত্র দূরে। পৃথিবী যতটা দূর বাঁচিয়ে চলে তার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। বুধের গায়ে ঝাপসা কিছু কিছু দাগ দেখা যায় সেইটে লক্ষ্য করে বোঝা গেছে কেবল ওর এক পিঠ ফেরানো সূর্যের দিকে। সূর্যের চারদিক ঘুরে আসতে ওর লাগে ৮৮ দিন। নিজের মেরুদণ্ড ঘুরতেও ওর লাগে তাই। সূর্য প্রদক্ষিণের পথে পৃথিবীর দৌড়, প্রতি সেকেণ্ডে উনিশ মাইল। বুধগ্রহের দৌড় তাকে ছাড়িয়ে গেছে, তার বেগ প্রতি সেকেণ্ডে ত্রিশ মাইল। একে ওর রাস্তা ছোটো তাতে ওর ব্যস্ততা বেশি, তাই পৃথিবীর শিকি সময়েই ওর প্রদক্ষিণ সারা হয়ে যায়। বুধগ্রহের প্রদক্ষিণের যে পথ, সূর্য ঠিক তার কেন্দ্রে নেই, একটু এক পাশে আছে। সেইজন্যে ঘোরবার সময় বুধগ্রহ কখনো সূর্যের অপেক্ষাকৃত কাছে আসে কখনো যায় দূরে।

 এই গ্রহ সূর্যের এত কাছে থাকাতে তাপ পাচ্ছে খুব বেশি। অতি সূক্ষ্ম পরিমাণ তাপ মাপবার একটি যন্ত্র বেরিয়েছে ইংরেজিতে তার নাম thermo-couple। তাকে দুরবীনের সঙ্গে জুড়ে গ্রহতারার তাপের খবর জানা যায়। এই যন্ত্রের হিসাব অনুসারে, বুধগ্রহের যে অংশ সূর্যের দিকে ফিরে থাকে তার তাপ সীসে টিন গলাতে পারে। এই তাপে বাতাসের অণু এত বেশি বেগে চঞ্চল হয়ে ওঠে যে বুধগ্রহ তাদের ধরে রাখতে পারে না, তারা দেশ ছেড়ে শূন্যে দেয় দৌড়। বাতাসের অণু পলাতক স্বভাবের। পৃথিবীতে তারা সেকেণ্ডে দুই মাইলমাত্র বেগে ছুটোছুটি করে, তাই টানের জোরে পৃথিবী তাদের সামলিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু যদি কোনো কারণে তাপ বেড়ে উঠে ওদের দৌড় হোত সেকেণ্ডে সাত মাইল, তাহলেই পৃথিবী আপন হাওয়াকে আর বশ মানাতে পারত না।

 যেসব বিজ্ঞানী বিশ্বজগতের হিসাবনবিশ তাদের একটা প্রধান কাজ হচ্ছে গ্রহ নক্ষত্রের ওজন ঠিক করা। এ-কাজে সাধারণ দাড়িপাল্লার ওজন চলে না, তাই কৌশলে ওঁদের খবর আদায় করতে হয়। সেই কথাটা বুঝিয়ে বলি। মনে করো একটা গড়ানে গোলা হঠাৎ এসে পথিককে দিলে ধাক্কা, সে পড়ল দশ হাত দূরে। কতখানি ওজনের গোল এসে জোর লাগালে মানুষটা এতখানি বিচলিত হয়, তার নিয়মটা যদি জানা থাকে তাহলে এ দশ হাতের মাপটা নিয়ে গোলাটার ওজন অঙ্ক কষে বের করা যেতে পারে। একবার হঠাৎ এইরকম অঙ্ক কষার সুযোেগ ঘটাতে বুধগ্রহের ওজন মাপা সহজ হয়ে গেল। সুবিধাটা ঘটিয়ে দিলে একটা ধূমকেতু।
হ্যালির ধূমকেতু, ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ
সে-কথাটা বলবার আগে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার ধূমকেতুরা কী রকম ধরনের জ্যোতিষ্ক।

 ধূমকেতু শব্দের মানে ধোঁয়ার নিশান। ওর চেহারা দেখে নামটার উৎপত্তি। গোল মুণ্ড আর তার পিছনে উড়ছে উজ্জ্বল একটা লম্বা পুচ্ছ। সাধারণত এই হোলো ওর আকার। এই পুচ্ছটা অতিসূক্ষ্ম বাষ্পের। এত সূক্ষ্ম যে কখনো কখনো তাকে মাড়িয়ে গিয়েছে পৃথিবী, তবু সেটা অনুভব করতে পারিনি। ওর মুণ্ডটা উল্কাপিণ্ড দিয়ে তৈরি। এখনকার বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা এই মত স্থির করেছেন যে ধূমকেতুরা সূর্যের বাঁধা অনুচরেরই দলে। কয়েকটা থাকতে পারে যারা পরিবারভুক্ত নয় যারা আগন্তুক।

 একবার একটি ধূমকেতুর প্রদক্ষিণপথে ঘটল অপঘাত। বুধের কক্ষপথের পাশ দিয়ে যখন সে চলছিল তখন বুধের সঙ্গে টানাটানিতে তার পথের হয়ে গেল গোলমাল। রেলগাড়ি রেলচ্যুত হোলে আবার তাকে রেলে ঠেলে তোল হয় কিন্তু টাইম-টেবিলের সময় পেরিয়ে যায়। এক্ষেত্রে তাই ঘটল। ধূমকেতুটা আপন পথে যখন ফিরল তখন তার নির্দিষ্ট সময় হয়েছে উত্তীর্ণ। ধূমকেতুকে যে পরিমাণ নড়িয়ে দিতে বুধগ্রহের যতখানি টানের জোর লেগেছিল তাই নিয়ে চলল অঙ্ককষা। যার যতটা ওজন সেই পরিমাণ জোরে সে টান লাগায় এটা জানা কথা, এর থেকেই বেরিয়ে পড়ল বুধগ্রহের ওজন। দেখা গেল তেইশটা বুধগ্রহের বাটখারা চাপাতে পারলেই তবেই তা পৃথিবীর ওজনের সমান হয়।

 বুধগ্রহের পরের রাস্তাতেই আসে শুক্রগ্রহের প্রদক্ষিণের পালা। তার ২২৫ দিন লাগে সূর্য ঘুরে আসতে। অর্থাৎ আমাদের সাড়ে সাত মাসে তার বৎসর। ওর মেরুদণ্ড-ঘোরা ঘূর্ণিপাকের বেগ কতটা তা নিয়ে এখনো তর্ক শেষ হয়নি। এই গ্রহটি বছরের এক সময়ে সূর্যাস্তের পরে পশ্চিম দিগন্তে দেখা দেয়, তখন তাকে বলি সন্ধ্যাতারা, আবার এই গ্রহই আর একসময়ে সূর্য ওঠবার আগে পুবদিকে ওঠে তখন তাকে শুকতারা বলে জানি। কিন্তু মোটেই এ তারা নয়, খুব জ্বলজ্বল করে বলেই সাধারণের কাছে তারা-খেতাব পেয়েছে। এর আয়তন পৃথিবীর চেয়ে অল্প একটু কম। এই গ্রহের পথ পৃথিবীর পথের চেয়ে আরো তিন কোটি মাইল সূর্যের কাছে। সেও কম নয়। যথোচিত দূর বাঁচিয়ে আছে তবু এর ভিতরকার খবর ভালো করে পাইনে। সে সূর্যের আলোর প্রখর আবরণের জন্যে নয়। বুধকে ঢেকেছে সূর্যেরই আলো, আর শুক্রকে ঢেকেছে এর নিজেরই ঘন মেঘ। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন শুক্রগ্রহের যে উত্তাপ তাতে জলের বিশেষ রূপান্তর হয় না। কাজেই ওখানে জলাশয় আর মেঘ দুইয়ের অস্তিত্বই আশা করতে পারি।

 মেঘের উপরিতলা থেকে যতটা আন্দাজ করা যায় তাতে প্রমাণ হয় এই গ্রহের অক্সিজেন-সম্বল নিতান্তই সামান্য। ওখানে যে গ্যাসের স্পষ্ট চিহ্ন পাওয়া যায় সে হচ্ছে আঙ্গারিক গ্যাস। মেঘের উপর তলায় তার পরিমাণ পৃথিবীর ঐ গ্যাসের চেয়ে বহু হাজার গুণ বেশি। পৃথিবীর এই গ্যাসের প্রধান ব্যবহার লাগে গাছপালার খাদ্য জোগাতে।

 এই আঙ্গারিক গ্যাসের ঘন আবরণে গ্রহটি যেন কম্বলচাপা। তার ভিতরের গরম বেরিয়ে আসতে পারে না। সুতরাং শুক্রগ্রহের উপরিতল ফুটন্ত জলের মতো কিংবা তার চেয়ে বেশি উষ্ণ।

 শুক্রে জোলো বাস্পের সন্ধান যে পাওয়া গেল না সেটা আশ্চর্যের কথা। শুক্রের ঘন মেঘ তাহলে কিসের থেকে সে কথা ভাবতে হয়। সম্ভব এই যে মেঘের উচ্চস্তরে ঠাণ্ডায় জল এত জমে গেছে যে তার থেকে বাষ্প পাওয়া যায় না।

 এ-কথাটা বিশেষ করে ভেবে দেখবার বিষয়। পৃথিবীতে সৃষ্টির প্রথমযুগে যখন গলিত বস্তুগুলো ঠাণ্ডা হয়ে জমাট বাঁধতে লাগল তখন অনেক পরিমাণে জোলো বাষ্প আর আঙ্গারিক গ্যাসের উদ্ভব হোলো। তাপ আরো কমলে পর জোলো বাষ্প জল হয়ে গ্রহতলে সমুদ্র বিস্তার করে দিলে। তখন বাতাসে যেসব গ্যাসের প্রাধান্য ছিল তারা নাইট্রোজেনের মতো সব নিষ্ক্রিয় গ্যাস। অক্সিজেন-গ্যাসটা তৎপর জাতের মিশুক, অন্যান্য পদার্থের সঙ্গে মিশে যৌগিক পদার্থ তৈরি করা তার স্বভাব। এমনি করে নিজেকে সে রূপান্তরিত করতে থাকে। তৎসত্ত্বেও পৃথিবীর হাওয়ায় এতটা পরিমাণ অক্সিজেন বিশুদ্ধ হয়ে টিঁকল কী ক’রে।

 তার প্রধান কারণ পৃথিবীর গাছপালা। উদ্ভিদের বাতাসের আঙ্গারিক গ্যাস থেকে অঙ্গারপদার্থ নিয়ে নিজেদের জীবকোষ তৈরি করে, মুক্তি দেয় অক্সিজেনকে। তার পরে প্রাণীদের নিশ্বাস ও লতাপাতার পানি থেকে আবার আঙ্গারিক গ্যাস উঠে আপন তহবিল পূরণ করে। পৃথিবীতে সম্ভবত প্রাণের বড়ো অধ্যায়টা আরম্ভ হোললা তখনি যখন সামান্য কিছু অক্সিজেন ছিল সেই আদিকালের উদ্ভিদের মধ্যে। এই উদ্ভিদের পালা যতই বেড়ে চলল ততই তাদের নিশ্বাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে তুললে। কমে গেল আঙ্গারিক গ্যাস।

 অতএব সম্ভবত শুক্র গ্রহের অবস্থা সেই আদিকালের পৃথিবীর মতো। একদিন হয়তো কোনো ফাঁকে উদ্ভিদ দেখা দেবে, আর আঙ্গারিক গ্যাস থেকে অক্সিজেনকে ছাড়া দিতে থাকবে। তার পরে বহু দীর্ঘকালে ক্রমশ জীবজন্তুর পালা হবে শুরু। চাঁদ আর বুধগ্রহের অবস্থা ঠিক এর উলটো। সেখানে জীবপালনযোগ্য হাওয়া টানের দুর্বলতাবশত দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গিয়েছিল।

 সৌরমণ্ডলীতে শুক্রগ্রহের পরের আসনটা পৃথিবীর। অন্য গ্রহদের কথা শেষ করে তার পরে পৃথিবীর খবর নেওয়া যাবে।

 পৃথিবীর পরের পংক্তিতেই মঙ্গলগ্রহের স্থান। এই লালচে রঙের গ্রহটিই অন্য গ্রহদের চেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে। এর আয়তন পৃথিবীর প্রায় নয় ভাগের এক ভাগ। সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে এর লাগে ৬৮৭ দিন। যে পথে এ সূর্যের প্রদক্ষিণ করছে তা অনেকটা ডিমের মতো; তাই ঘোরার সময় একবার সে আসে সূর্যের কাছে আবার যায় দূরে। আপন মেরুদণ্ডের চারদিকে এ গ্রহের ঘুরতে লাগে পৃথিবীর চেয়ে আধঘণ্টা মাত্র বেশি, তাই সেখানকার দিন রাত্রি আমাদের পৃথিবীর দিনরাত্রির চেয়ে একটু বড়ো। এই গ্রহে যে-পরিমাণ বস্তু আছে, তা পৃথিবীর বস্তুমাত্রার দশ ভাগের এক ভাগ, তাই টানবার শক্তিও সেই পরিমাণে কম।

 সূর্যের টানে মঙ্গলগ্রহের ঠিক যে-পথ বেয়ে চলা উচিত ছিল, তার থেকে ওর চাল একটু তফাত। পৃথিবীর টানে ওর এই দশা। ওজন অনুসারে টানের জোরে পৃথিবী মঙ্গলগ্রহকে কতখানি টলিয়েছে সেইটে হিসেব করে পৃথিবীর ওজন ঠিক হয়েছে। এইসূত্রে সূর্যের দূরত্বও ধরা পড়ল। কেননা মঙ্গলকে সূর্যও টানছে পৃথিবীও টানছে, সূর্য কতটা পরিমাণে দূরে থাকলে দুই টানে কাটাকাটি হয়ে মঙ্গলের এইটুকু বিচলিত হওয়া সম্ভব সেটা গণনা করে বের করা যেতে পারে। মঙ্গলগ্রহ বিশেষ বড়ো গ্রহ নয়, তার ওজনও অপেক্ষাকৃত কম সুতরাং সেই অনুসারে টানের জোর বেশি না হওয়াতে তার হাওয়া খোওয়াবার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু সূর্য থেকে যথেষ্ট দূরে আছে বলে এতটা তাপ পায় না যাতে হাওয়ার অণু গরমে উধাও হয়ে চলে যেতে পারে। মঙ্গলগ্রহের হাওয়ায় অক্সিজেন সন্ধানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সামান্য কিছু থাকতে পারে। মঙ্গলগ্রহের লাল রঙে অনুমান হয় সেখানকার পাথরগুলো অক্সিজেনের সংযোগে সম্পূর্ণ মরচে-পড়া হয়ে গেছে। আর জলীয় বাষ্পের যা চিহ্ন পাওয়া গেল তা পৃথিবীর জলীয় বাষ্পের শতকরা পাঁচ ভাগের এক ভাগ। মঙ্গলগ্রহের হাওয়ায় এই যে অকিঞ্চনতার লক্ষণ দেখা যায় তাতে বোঝা যায় পৃথিবী ক্রমে ক্রমে একদিন আপন সম্বল খুইয়ে এই দশায় পেঁৗছবে।

 পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের চেয়ে মঙ্গল থেকে তার দূরত্ব বেশি অতএব নিঃসন্দেহ এ গ্রহ অনেকটা ঠাণ্ডা। দিনের বেলায় বিষুবপ্রদেশে হয়তো কিছু গরম থাকে কিন্তু রাতে নিঃসন্দেহ বরফজমা শীতের চেয়ে আরো অনেক শীত বেশি। বরফের টুপি-পরা তার মেরুপ্রদেশের তো কথাই নেই। এই গ্রহের মেরুপ্রদেশে বরফের টুপিটা বাড়ে কমে, মাঝে মাঝে তাদের দেখাও যায় না। এই গলে-যাওয়া টুপির আকারপরিবর্তন যন্ত্রদৃষ্টিতে ধরা পড়ে। এই গ্রহতলের অনেকটা ভাগ মরুর মতো শুকনো। কেবল গ্রীষ্মঋতুতে কোনো কোনো অংশ শ্যামবর্ণ হয়ে ওঠে, সম্ভবত জল চলার রাস্তায় বরফ গলার দিনে গাছপালা গজিয়ে উঠতে থাকে।

 মঙ্গলগ্রহকে নিয়ে পণ্ডিতে পণ্ডিতে একটা তর্ক চলেছে অনেকদিন ধরে। একদা একজন ইতালীয় বিজ্ঞানী মঙ্গলে লম্বা লম্বা আঁচড় দেখতে পেলেন, বললেন, নিশ্চয়ই এ গ্রহের বাসিদেরা মেরুপ্রদেশ থেকে বরফ-গলা জল পাবার জন্যে খাল কেটেছে। আবার কোনো কোনো বিজ্ঞানী বললেন, ওটা চোখের ভুল। ইদানীং জ্যোতিষ্কলোকের দিকে মানুষ ক্যামেরা চালিয়েছে। সেই ক্যামেরা-তোলা ছবিতেও কালো দাগ দেখা যায়। কিন্তু ওগুলো যে কৃত্রিম খাল, আর বুদ্ধিমান জীবেরই কীতি সেটা নিতান্তই আন্দাজের কথা। অবশ্য এ গ্রহে প্রাণী থাকা অসম্ভব নয়, কেননা এখানে হাওয়া জল আছে।

 দুটি উপগ্রহ মঙ্গলগ্রহের চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়। একটির একপাক শেষ করতে লাগে ত্রিশ ঘণ্টা, আর-একটির সাড়ে সাত ঘণ্টা, অর্থাৎ মঙ্গলগ্রহের একদিনরাত্রির মধ্যে সে তাকে ঘুরে আসে প্রায় তিনবার। আমাদের চাঁদের চেয়ে এরা প্রদক্ষিণের কাজ সেরে নেয় অনেক শীঘ্র।

 মঙ্গল আর বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথের মাঝখানে অনেক খানি ফাঁকা জায়গা দেখে পণ্ডিতেরা সন্দেহ ক’রে খোঁজ করতে লেগে গেলেন। প্রথমে অতি ছোটো চারিটি গ্রহ দেখা দিল। তারপরে দেখা গেল ওখানে বহুহাজার টুকরো-গ্রহের ভিড়। ঝাঁকে ঝাঁকে তারা ঘুরছে সূর্যের চারিদিকে। ওদের নাম দেওয়া যাক গ্রহিকা। ইংরেজিতে বলে asteroids। প্রথম যার দর্শন পাওয়া গেল তার নাম দেওয়া হয়েছে সীরিস (Ceres), তার ব্যাস চারশো পঁচিশ মাইল। ঈবোস (Eros) বলে একটি গ্রহিকা আছে, সূর্যপ্রদক্ষিণের সময় সে পৃথিবীর যত কাছে আসে, এমন আর কোনো গ্রহই আসে। এরা এত ছোটো যে এদের ভিতরকার কোনো বিশেষ খবর পাওয়া যায় না। এদের সবগুলোকে জড়িয়ে যে ওজন পাওয়া যায় তা পৃথিবীর ওজনের শিকি ভাগেরও কম। মঙ্গলের চেয়ে কম, নইলে মঙ্গলের চলার পথে টান লাগিয়ে কিছু গোল বাধাত।

 এই টুকরো-গ্রহগুলিকে কোনো একটা আস্ত-গ্রহেরই ভগ্নশেষ বলে মনে করা যেতে পারে। কিন্তু পণ্ডিতেরা বলেন সে-কথা যথার্থ নয়। বলা যায় না কী কারণে এরা জোট বেঁধে গ্রহ আকার ধরতে পারেনি।

 এই গ্রহিকাদের প্রসঙ্গে আর-এক দলের কথা বলা উচিত। তারাও অতি ছোটো, তারাও ঝাঁক বেঁধে চলে এবং নির্দিষ্ট পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে থাকে, তারা উল্কাপিণ্ডের দল। পৃথিবীতে ক্রমাগতই তাদের বর্ষণ চলছে, ধুলার সঙ্গে তাদের যে ছাই মিশেছে সে বড়ো কম নয়। পৃথিবীর উপরে হাওয়ার দোয়া না থাকলে এইসব ক্ষুদ্র শত্রুর আক্রমণে আমাদের রক্ষা থাকত না।

 উল্কাপাত দিনে রাতে কিছু না কিছু হয়ে থাকে। কিন্তু বিশেষ বিশেষ মাসের বিশেষ বিশেষ দিনে উল্কাপাতের ঘটা হয় বেশি। ২১শে এপ্রিল, ৯, ১০, ১১ই আগস্ট, ১২, ১৩, ১৪ই ও ২৭শে নভেম্বরের রাত্রে এই উল্কাবৃষ্টির আতশবাজি দেখবার মতো জিনিস। এ-সম্বন্ধে দিনক্ষণের বাঁধাবাঁধি দেখে বিজ্ঞানীরা কারণ খোঁজ করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন।

 ব্যাপারটা হচ্ছে এই, ওদের একটা বিশেষ পথ আছে। কিন্তু গ্রহদের মতো ওরা একা চলে না, ওরা দ্যুলোকের দলবাঁধা পঙ্গপালের জাত। লক্ষ লক্ষ চলেছে ভিড় করে এক রাস্তায়। বৎসরের বিশেষ বিশেষ দিনে পৃথিবী গিয়ে পড়ে ঠিক ওদের যেখানে জটলা। পৃথিবীর টান ওরা সামলাতে পারে না। রাশি রাশি বর্ষণ হোতে থাকে। পৃথিবীর ধুলোয় ধুলো হয়ে যায়। কখনো কখনো বড়ো বড়ো টুকরোও পড়ে, ফেটেফুটে চারিদিক ছারখার করে দেয়। সূর্যের এলেকায় অনধিকার প্রবেশ করে বিপন্ন হয়েছে এমন ধূমকেতুর এরা দুর্ভাগ্যের নিদর্শন। এমন কথাও শোনা যায় তরুণ বয়সে পৃথিবীর অন্তরে যখন তাপ ছিল বেশি, তখন অগ্ন্যুৎপাতে পৃথিবীর ভিতরের সামগ্রী এত উপরে ছুটে গিয়েছিল যে পৃথিবীর টান এড়িয়ে গিয়ে সূর্যের চারদিকে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, মাঝে মাঝে নাগাল পেলেই আবার তাদের পৃথিবী নেয় টেনে। বিশেষ বিশেষ দিনে সেই উল্কার যেন হরির লুট হোতে থাকে। আবার এমন অনেক উল্কাপিণ্ডের সন্ধান মিলেছে যারা সৌরমণ্ডলীর বাইরে থেকে এসে ধরা পড়ে পৃথিবীর টানে। বিশ্বের কোথাও হয়তো একটা প্রলয়কাণ্ড ঘটেছিল যার উদ্দামতায় বস্তুপিণ্ড ভেঙে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়েছিল। এই উল্কার দল আজ তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

 এই অতিক্ষুদ্রদের পরের রাস্তাতেই দেখা দেয় অতিমস্ত বড় গ্রহ বৃহস্পতি।

 এই বৃহস্পতিগ্রহের কাছ থেকে কোনো পাকা খবর প্রত্যাশা করার পূর্বে দুটি জিনিস লক্ষ্য করা দরকার। সূর্য থেকে তার দূরত্ব, আর তার আয়তন। পৃথিবীর দূরত্ব ৯ কোটি মাইলের কিছু উপর আর বৃহস্পতির দূরত্ব ৪৮ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল, অর্থাৎ পৃথিবীর দূরত্বের চেয়ে পাঁচগুণেরও বেশি। পৃথিবী সূর্যের যতটা তাপ পায়, বৃহস্পতি পায় তার সাতাশ ভাগের এক ভাগ মাত্র।

 এককালে জ্যোতিষীরা আন্দাজ করেছিলেন যে, বৃহস্পতিগ্রহ পৃথিবীর মতো এত ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি, তার নিজের যথেষ্ট ভাপের সঞ্চয় আছে। তার বায়ুমণ্ডলে সর্বদা যে চঞ্চলতা দেখা যায় তার নিজের অন্তরের তাপই তার কারণ। কিন্তু যখন বৃহস্পতির তাপমাত্রার হিসাব কষা সম্ভব হোলদা তখন দেখা গেল গ্রহটি অত্যন্তই ঠাণ্ডা। বরফজমা শৈত্যের চেয়ে আরও ২৮০ ফারেনহাইট ডিগ্রির তলায় পৌছায় তার তাপমাত্রা। এত অত্যন্ত বেশি ঠাণ্ডায় বৃহস্পতির জোলো বাষ্প থাকতেই পারে না। তার বায়ুমণ্ডল থেকে দুটো গ্যাসের কিনারা পাওয়া গেল। একটা হচ্ছে আমোনিয়া, নিশাদলে যার তীব্রগন্ধে চমক লাগায়, আর একটা আলেয়া গ্যাস, মাঠের মধ্যে পথিকদের পথ ভোলাবার জন্যে যার নাম আছে। নানাপ্রকার যুক্তি মিলিয়ে আপাতত স্থির হয়েছে যে, বৃহস্পতির দেহ কঠিন, প্রায় পৃথিবীর সমান ঘন। বৃহস্পতির ভিতরকার পাথুরে জঠরটার প্রসার বাইশ হাজার মাইল; এর উপরে বরফের স্তর জমে রয়েছে যোলো হাজার মাইল। এই বরফপুঞ্জের উপরে আছে ৬০০০ মাইল বায়ুস্তর। এত বড়ো রাশ-করা বাতাসের প্রবল চাপে হাইড্রোজেনও তরল হয়ে যায়। অতএব এই গ্রহে ঘটেছে কঠিন বরফস্তরের উপরে তরল গ্যাসের সমুদ্র। আর তার বায়ুমণ্ডলের উধ্বস্তর তরল অ্যামোনিয়াবিন্দুতে তৈরি।

 বৃহস্পতি অতিকায় গ্রহ, ওর ব্যাস প্রায় নব্বই হাজার মাইল, আয়তনে পৃথিবীর চেয়ে তেরোশোগুণ বড়।

 সূর্য প্রদক্ষিণ করতে বৃহস্পতির লাগে প্রায় বারো বৎসর। দূরে থাকাতে ওর কক্ষপথ পৃথিবী থেকে অনেক বড় হয়েছে সন্দেহ নেই কিন্তু ও চলেও যথেষ্ট মন্দ গমনে। পৃথিবী যেখানে উনিশ মাইল চলে এক সেকেণ্ডে, ও চলে আট মাইল মাত্র। কিন্তু ওর স্বাবর্তন অর্থাৎ নিজের মেরুদণ্ডের চারদিকে ঘোরা খুবই দ্রুত বেগে। অত বড়ো বিপুল দেহটাকে পাক খাওয়াতে ওর লাগে দশ ঘণ্টা। আমাদের একদিন একরাত্রি সময়ের মধ্যে ওর দুই দিনরাত্রি শেষ হয়েও উদ্বৃত্ত থাকে।

 নয়টি উপগ্রহ নিয়ে বৃহস্পতির পরিবারমণ্ডলী। দশম উপগ্রহের খবর পাওয়া গেছে, কিন্তু সে-খবর পাকা হয়নি। পৃথিবীর চাঁদের চেয়ে এই চাদগুলোর বৃহস্পতি-প্রদক্ষিণবেগ অনেক বেশি দ্রুত। প্রথম চারিটি উপগ্রহ আমাদেরই চাদের মতো বড়ো। তাদের আছে অমাবস্যা পূর্ণিমা এবং ক্ষয়বৃদ্ধি।

 বৃহস্পতির সব-দূরের দুটি উপগ্রহ তার দলের অন্যান্য উপগ্রহের উলটো মুখে চলে। এর থেকে কেউ কেউ আন্দাজ করেন, এরা এককালে ছিল দুটো গ্রহিকা, বৃহস্পতির টানে ধরা পড়ে গেছে। আলো যে এক সেকেণ্ডে ১৮৬০০০ মাইল বেগে ছুটে চলে তা প্রথম স্থির হয় বৃহস্পতির চন্দ্রগ্রহণ থেকে। হিসাবমতে বৃহস্পতির উপগ্রহের গ্রহণ যখন ঘটবার কথা, প্রত্যেক বারে তার কিছুকাল পরে ঘটতে দেখা যায়। তার কারণ, ওর আলো আমাদের চোখে পড়তে কিছু দেরি করে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় নিয়ে আলো চলে, এ যদি না হোত

শনি ও পৃথিবীর আয়তনের তুলনা

সময়। তাহলে গ্রহণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রহণের ঘটনাটা দেখা যেত। পৃথিবী থেকে এই উপগ্রহের দূরত্ব মেপে ও গ্রহণের মেয়াদ কতকটা পেরিয়েছে সেটা লক্ষ্য করে আলোর বেগ প্রথম হিসাব করা হয়।

 বৃহস্পতির নিজস্ব আলো নেই তার প্রমাণ পাওয়া যায় বৃহস্পতির নয় নয়টি উপগ্রহের গ্রহণের গ্রহণটা হয় কী করে ভেবে দেখো। কোনো এক যোগাযোগে যখন সূর্য থাকে পিছনে, আর গ্রহ থাকে আলো আড়াল করে সূর্যের সামনে, আর তারো সামনে থাকে গ্রহের ছায়ায় উপগ্রহ, তখনি সূর্যালোক পেতে বাধা পেয়ে উপগ্রহে লাগে গ্রহণ। কিন্তু মধ্যবর্তী গ্রহের নিজেরই যদি আলো থাকত, তাহলে সেই আলো পড়ত উপগ্রহে, গ্রহণ হোতেই পারত। আমাদের চাঁদের গ্রহণেও সেই একই কথা। চাঁদের কাছ থেকে সূর্যকে যখন সে আড়াল করে, তখন জ্যোতিহীন পৃথিবী চাদকে ছায়াই দিতে পারে, নিজের থেকে আলো দিতে পারে না।

 বৃহস্পতি গ্রহের পরের পংক্তিতে আসে শনিগ্রহ।

 এ গ্রহ আছে সূর্য থেকে ৮৮ কোটি ৬০ লক্ষ মাইল দূরে। আর ২৯॥ ৩ বছরে এক পাক তার সূর্য প্রদক্ষিণ। শনির বেগ বৃহস্পতির চেয়েও কম—এক সেকেণ্ডে ছ মাইল মাত্র। বৃহস্পতি ছাড়া সৌরজগতের অন্য গ্রহের চেয়ে এর আকার অনেক বড়ে; এর ব্যাস পৃথিবীর প্রায় নয় গুণ। পৃথিবীর ব্যাসের চেয়ে নয়গুণ বড়ো হয়েও একপাক ঘুর খেতে ওর লাগে পৃথিবীর অধেকের চেয়েও কম সময়। এত জোরে ঘুরছে ব’লে সেই বেগের ঠেলায় ওর আকার হয়েছে কিছু চ্যাপটা ধরনের। এত বড়ো এর আয়তন অথচ ওজন পৃথিবীর ৯৫ গুণ মাত্র বেশি। এত হালকা ব’লে এই প্রকাণ্ড আয়তন সত্ত্বেও টানবার শক্তি পৃথিবীর চেয়ে এর বেশি নয়। একটি মেঘের আবরণ একে ঘিরে আছে, যার আকার-বদল মাঝে মাঝে দেখা যায়।

 শনির উপগ্রহ আছে নয়টি। সবচেয়ে বড়ো যেটি, আয়তনে সে বুধগ্রহের চেয়েও বড়ো, প্রায় আট লক্ষ মাইল দূরে থাকে, ষোলো দিনে তার প্রদক্ষিণ শেষ হয়।

 শনিগ্রহের বেষ্টনীর বর্ণচ্ছটা-পরীক্ষায় দেখা গেছে যে এই বেষ্টনীর যেসব অংশ গ্রহের কাছাকাছি আছে তাদের চলনবেগ বাইরের দূরবর্তী অংশের চেয়ে অনেক বেশি। বেষ্টনী যদি অখণ্ড চাকার মতো হোত, তাহলে ঘূর্ণিচাকার নিয়মে বেগটা বাইরের দিকে বেশি হোত। কিন্তু শনির বেষ্টনী যদি খণ্ড খণ্ড জিনিস নিয়ে হয় তাহলে তাদের যে দল গ্রহের কাছে, টানের জোরে তারাই ঘুরবে বেশি বেগে। এইসব লক্ষ লক্ষ টুকরো উপগ্রহ ছাড়াও ন’টি বড়ো উপগ্রহ ভিন্ন পথে শনিগ্রহকে প্রদক্ষিণ করছে।

 কী করে যে এ গ্রহের চারিদিকে দলে দলে ছোটো-ছোটো টুকরো সৃষ্টি হোললা, সে-সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের যে মত তারই কিছু এখানে বলা যাক। গ্রহের প্রবল টানে কোনো উপগ্রহই আপন গোল আকার রাখতে পারে না, শেষ পর্যন্ত অনেকটা তার ডিমের মতো চেহারা হয়। অবশেষে এমন এক সময় আসে যখন টান আর সহ্য করতে না পেরে উপগ্রহ ভেঙে দু-টুকরো হয়ে যায়। এই ছছাটো টুকরোদুটিও আবার ভাঙতে থাকে। এমনি করে ভাঙতে ভাঙতে একটিমাত্র উপগ্রহ থেকে লক্ষ লক্ষ টুকরো বেরোনো অসম্ভব হয় না। চাঁদেরও একদিন এই দশা হবার কথা। বিজ্ঞানীরা বলেন যে, প্রত্যেক গ্রহকে ঘিরে আছে একটি করে অদৃশ্য মণ্ডলীর বেড়া, তাকে বলে বিপদের গণ্ডি। তার মধ্যে এসে পড়লেই উপগ্রহের দেহ ফেঁপে উঠে ডিমের মতো লম্বাটে আকার ধরে, তারপরে থাকে ভাঙতে। শেষকালে টুকরোগুলো জোট বেঁধে ঘুরতে থাকে গ্রহের চারদিকে। বিজ্ঞানীদের মতে বৃহস্পতির প্রথম উপগ্রহ এই অদৃশ্য বিপদ-গণ্ডির কাছে এসে পড়েছে, আর কিছুদিন পরে সেখানে ঢুকলেই খণ্ড খণ্ড হয়ে যাবে। শনিগ্রহের মতো বৃহস্পতির চারদিক ঘিরে তখন তৈরি হবে একটি উজ্জ্বল বেষ্টনী। শনিগ্রহের চারিদিকে যে বেষ্টনীর কথা বলা হলো তার সৃষ্টি সম্বন্ধে পণ্ডিতেরা আন্দাজ করেন যে অনেকদিন আগে শনির একটি উপগ্রহ ঘুরতে ঘুরতে এর বিপদ-গণ্ডির ভিতরে গিয়ে পড়েছিল তার ফলে উপগ্রহটা ভেঙে টুকরো হয়ে আজও এই গ্রহের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

 পৃথিবীর বিপদগণ্ডির অনেকটা বাইরে আছে বলে চাঁদের যা পরিবর্তন হয়েছে তা খুব বেশি না। পৃথিবীর টানের জোরে আস্তে আস্তে চাদ তার কাছে এগিয়ে আসছে, তার পরে যখন ঐ বেড়ার মধ্যে অপঘাতের এলেকায় প্রবেশ করবে তখন যাবে টুকরো টুকরো হয়ে, আর সেই টুকরোগুলো পৃথিবীর চারদিক ঘিরে শনিগ্রহের নকল করতে থাকবে, তখন হবে তার শনির দশা।

 কেম্ব্রিজের অধ্যাপক জেফরের মত এর উলটো। তিনি বলেন চাদে পৃথিবীতে দূরত্ব বেড়েই চলেছে। অবশেষে চান্দ্রমাসে সৌরমাসে সমান হয়ে যাবে, তখন কাছের দিকে টানবার পালা শুরু হবে।

 বৃহস্পতির চেয়ে শনি সূর্য থেকে আরো বেশি দূরে— কাজেই ঠাণ্ডাও আরো বেশি। এর বাইরের দিকের বায়ুমণ্ডল অনেকটা বৃহস্পতির মতে, কেবল অ্যামোনিয়া তত বেশি জানা যায় না, আলেয়া গ্যাসের পরিমাণ শনিতে বৃহস্পতির চেয়ে বেশি। শনি যদিও পৃথিবীর চেয়ে আয়তনে অনেক বড় তবু তার ওজন সে-পরিমাণে বেশি নয়। বৃহস্পতির মতো এর বায়ুমণ্ডল গভীর হবার কথা, কেননা এর টান এড়িয়ে বাতাসের পালাবার পথ নেই। এর বাতাসের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি বলেই এর গড়পড়তা ওজন আয়তনের তুলনায় এত এর ভিতরের কঠিন অংশের ব্যাস ২৪০০০ মাইল, তার উপরে প্রায় ৬০০০ মাইল বরফ জমেছে—আর তার উপরে আছে ১৬০০০ মাইল হাওয়া।

 শনিগ্রহের পরের মণ্ডলীতে আছে য়ুরেনস নামক এক নতুন-খবর-পাওয়া গ্রহ।

 এ গ্রহ সম্বন্ধে বিশেষ বিবরণ কিছু জানা সম্ভব হয়নি। এর আয়তন পৃথিবীর ৬৪ গুণ বেশি। সূর্য থেকে ১৭৮ কোটি ২৮ লক্ষ মাইল দূর থেকে সেকেণ্ডে চার মাইল বেগে ৮৪ বছরে একবার তাকে প্রদক্ষিণ করে। এত বড়ো এর আয়তন কিন্তু খুব দূরে আছে বলে দুরবীন ছাড়া একে দেখা যায় না। যে জিনিসে এ গ্রহ তৈরি তা জলের চেয়ে একটু ঘন, তাই পৃথিবী থেকে বহু গুণ বড়ো হোলেও, এর ওজন পৃথিবীর ১৫ গুণ মাত্র।

  ১০ ঘণ্টা ৪৩ মিনিটে এ গ্রহ একবার ঘুরপাক খাচ্ছে। চারিটি উপগ্রহ নিজ নিজ পথে ক্রমাগত একে প্রদক্ষিণ করছে।

 য়ুরেনস আবিষ্কারের কিছুকাল পরেই পণ্ডিতেরা য়ুরেনসের বেহিসাবি চলন দেখে স্থির করলেন, এ গ্রহ পথের নিয়ম ভেঙেছে আর একটা কোনো গ্রহের টানে। খুঁজতে খুঁজতে বেরোল সেই গ্রহ। তার নামকরণ হোলে নেপচুন।

 সূর্য থেকে এর দূরত্ব ২৭৯ কোটি ৩৫ লক্ষ মাইল, প্রায় ১৬৪ বছরে এ সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে। এর ব্যাস প্রায় ৩৩,০০০ মাইল, য়ুরেনসের চেয়ে কিছু বড়। দুরবীনে শুধু ছোটো একটি সবুজ থালার মতো দেখায়। একটি উপগ্রহ ২ লক্ষ ২২ হাজার মাইল দূরে থেকে ৫ দিন ২১ ঘণ্টায় একে একবার ঘুরে আসছে। উপগ্রহের দূরত্ব এবং এই গ্রহের আয়তন থেকে হিসাব করা হয়েছে যে এর বস্তুপদার্থ জল থেকে কিছু ভারি, ওজনে এ প্রায় য়ুরেনসের সমান। কত বেগে এ গ্রহ মেরুদণ্ডের চারদিকে ঘুরছে তা আজও একেবারে ঠিক হয়নি।

 নেপচুনের আকর্ষণে য়ুরেনসের যে নূতন পথে চলার কথা তা হিসেব করার পরেও দেখা গেল যে য়ুরেনস ঠিক সে-পথ ধরেও চলছে না। তার থেকে বোঝা গেল যে নেপচুন ছাড়া এ গ্রহের গতিপথের বাইরে রয়েছে আরো একটা জ্যোতিষ্ক। ১৯৩০ সালে বেরিয়ে পড়ল নূতন এক গ্রহ। তার নাম দেওয়া হলো প্লুটো। গ্রহ এত ছোটো ও এত দূরে যে, দুরবীনেও একে দেখা যায় না। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে নিঃসন্দেহে এর অস্তিত্ব প্রমাণ করা হয়েছে। এই গ্রহই সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে, তাই আলো উত্তাপ পাচ্ছে এত কম যে, এর অবস্থা আমরা কল্পনাও করতে পারিনে।

 ৩৯৬ কোটি মাইল দূর থেকে প্রায় ২৫০ বছরে এ গ্রহ সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে।

 প্লুটো গ্রহটির তাপমাত্রা হবে বরফগলা শৈত্যের ৪৪৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পরিমাপের নিচে। এত শীতে অত্যন্ত দুরন্ত গ্যাসও তরল এমন কি নিরেট হয়ে যায়। আঙ্গারিক গ্যাস, অ্যামোনিয়া, নাইট্রোজেন প্রভৃতি বায়ব পদার্থগুলো জমে বরফপিণ্ডে গ্রহটাকে নিশ্চয় ঢেকে ফেলেছে। কেউ কেউ মনে করেন সৌরলোকের শেষ সীমানায় কতকগুলো ছোটো ছোটো গ্রহ ছিটিয়ে আছে, প্লটো তাদের মধ্যে একটি কিন্তু এ মতের নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কখনো যাবে কি না বলা যায় না। এখনকার চেয়ে অনেক প্রবলতর দুরবীন ঐ দূরত্বের যবনিকা তুলতে যদি পারে তাহলেই সংশয়ের সমাধান হবে।