পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮০
চোখের বালি

বিনোদিনীর বক্ষোলগ্ন আশার সেই অশ্রুসিক্ত মুখখানি মনে পড়িয়া বিহারীর প্রায় কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল।

 বিহারীর এই প্রবল আবেগ দেখিয়া মহেন্দ্র আশ্চর্য হইয়া গেল। মহেন্দ্র জানিত, বিহারীর হৃদয়ের বালাই নাই— এ উপসর্গ কবে জুটিল। যেদিন কুমারী আশাকে দেখিতে গিয়াছিল, সেই দিন হইতে নাকি। বেচারা বিহারী! মহেন্দ্র মনে মনে তাহাকে বেচারা বলিল বটে, কিন্তু দুঃখবোধ না করিয়া বরঞ্চ একটু আমোদ পাইল। আশার মনটি একান্ত ভাবে যে কোন্ দিকে, তাহা মহেন্দ্র নিশ্চয় জানিত। ‘অন্য লোকের কাছে যাহারা বাঞ্ছার ধন, কিন্তু আয়ত্তের অতীত, আমার কাছে তাহারা চিরদিনের জন্য আপনি ধরা দিয়াছে’— ইহাতে মহেন্দ্র বক্ষের মধ্যে একটা গর্বের স্ফীতি অনুভব করিল।

 মহেন্দ্র বিহারীকে কহিল, “আচ্ছা চলো, যাওয়া যাক। তবে একটা গাড়ি ডাকো।”

২২

মহেন্দ্র ঘরে ফিরিয়া আসিবা মাত্র তাহার মুখ দেখিয়াই আশার মনের সমস্ত সংশয় ক্ষণকালের কুয়াশার মতো এক মুহূর্তেই কাটিয়া গেল। নিজের চিঠির কথা স্মরণ করিয়া মহেন্দ্রের সামনে সে যেন মুখ তুলিতেই পারিল না। মহেন্দ্র তাহার উপরে ভর্ৎসনা করিয়া কহিল, “এমন অপবাদ দিয়া চিঠিগুলা লিখিলে কী করিয়া।”

 বলিয়া পকেট হইতে বহুবার-পঠিত সেই চিঠি তিনখানি বাহির করিল। আশা ব্যাকুল হইয়া কহিল, “তোমার পায়ে পড়ি, ও চিঠিগুলা ছিঁড়িয়া ফেলো।”

 বলিয়া মহেন্দ্রের হাত হইতে চিঠিগুলা লইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িল। মহেন্দ্র তাহাকে নিরস্ত করিয়া সেগুলি পকেটে পুরিল। কহিল, “আমি কর্তব্যের অনুরোধে গেলাম, আর তুমি আমার অভিপ্রায় বুঝিলে না? আমাকে সন্দেহ করিলে!”

 আশা ছলছল চোখে কছিল, “এবারকার মতো আমাকে মাপ করো। এমন আর কখনোই হইবে না।”

 মহেন্দ্র কহিল, “কখনো না?”

 আশা কহিল, “কখনো না।”

 তখন মহেন্দ্র তাহাকে টানিয়া লইয়া চুম্বন করিল।

 আশা কহিল, “চিঠিগুলা দাও, ছিঁড়িয়া ফেলি।”

 মহেন্দ্র কহিল, “না, ও থাক্‌।”