পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭০
চোখের বালি

 বিদায়ের প্রভাতে শয্যাত্যাগ করিবার সময় মহেন্দ্র কহিল, “চুনি, আমার রত্ন, তোমাকে আমার হৃদয়ের সকলের উপরে ধারণ করিয়া রাখিব, সেখানে কেহ তোমাকে ছাড়াইয়া যাইতে পারিবে না।”

 তখন আশা দৃঢ়চিত্তে সর্বপ্রকার ত্যাগস্বীকারে প্রস্তুত হইয়া স্বামীর নিকট নিজের একটিমাত্র ক্ষুদ্র দাবি দাখিল করিল। কহিল, “তুমি আমাকে রোজ একখানি করিয়া চিঠি দিবে?”

 মহেন্দ্র কহিল, “তুমিও দিবে?”

 আশা কহিল, “আমি কি লিখিতে জানি।”

 মহেন্দ্র তাহার কানের কাছের অলকগুচ্ছ টানিয়া দিয়া কহিল, “তুমি অক্ষয়কুমার দত্তের চেয়ে ভালো লিখিতে পার— চারুপাঠ যাহাকে বলে।”

 আশা কহিল, “যাও! আমাকে আর ঠাট্টা করিয়ো না।”

 যাইবার পূর্বে আশা যথাসাধ্য নিজের হাতে মহেন্দ্রের পোর্ট্ম্যাণ্টো সাজাইতে বসিল। মহেন্দ্রের মোটা মোটা শীতের কাপড় ঠিকমত ভাঁজ করা কঠিন, বাক্সে ধরানো শক্ত— উভয়ে মিলিয়া কোনোমতে চাপাচাপি ঠাসাঠুসি করিয়া, যাহা এক বাক্সে ধরিত তাহাতে দুই বাক্স বোঝাই করিয়া তুলিল। তবু যাহা ভুলক্রমে বাকি রহিল তাহাতে আরো অনেকগুলি স্বতন্ত্র পুঁটুলির সৃষ্টি হইল। ইহা লইয়া আশা যদিও বারবার লজ্জাবোধ করিল, তবু তাহাদের কাড়াকড়ি কৌতুক ও পরস্পরের প্রতি সহাস্য দোষারোপে পূর্বেকার আনন্দের দিন ফিরিয়া আসিল। এ যে বিদায়ের আয়োজন হইতেছে তাহা আশা ক্ষণকালের জন্য ভুলিয়া গেল। সহিস দশবার গাড়ি-তৈয়ারির কথা মহেন্দ্রকে স্মরণ করাইয়া দিল, মহেন্দ্র কানে তুলিল না— অবশেষে বিরক্ত হইয়া বলিল, “ঘোড়া খুলিয়া দাও।”

 সকাল ক্রমে বিকাল হইয়া গেল, বিকাল সন্ধ্যা হয়। তখন স্বাস্থ্য পালন করিতে পরস্পরকে সতর্ক করিয়া দিয়া এবং নিয়মিত চিঠি লেখা সম্বন্ধে বারংবার প্রতিশ্রুত করাইয়া লইয়া ভারাক্রান্তহৃদয়ে পরস্পরের বিচ্ছেদ হইল।

 রাজলক্ষ্মী আজ দুইদিন হইল উঠিয়া বসিয়াছেন। সন্ধ্যাবেলায় গায়ে মোটা কাপড় মুড়ি দিয়া বিনোদিনীর সঙ্গে তাস খেলিতেছেন। আজ তাঁহার শরীরে কোনো গ্লানি নাই। মহেন্দ্র ঘরে প্রবেশ করিয়া বিনোদিনীর দিকে একেবারেই চাহিল না; মাকে কহিল, “ম, কলেজে আমার রাত্রের কাজ পড়িয়াছে, এখানে থাকিয়া সুবিধা হয় না— কলেজের কাছে বাসা লইয়াছি। সেখানে আজ হইতে থাকিব।”