পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫০
চোখের বালি

 প্রশ্ন করিবার পূর্বেই আশার কাছ হইতে এ সম্বন্ধে উচ্ছ্বাসপূর্ণ বিস্তারিত রিপোর্ট পাইবে, মহেন্দ্রের এরূপ দৃঢ় প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সেজন্য সবুর করিয়া যখন ফল পাইল না তখন লীলাচ্ছলে প্রশ্নটা উত্থাপন করিল।

 আশা মুশকিলে পড়িল। চোখের বালি কোনো কথাই বলে নাই। তাহাতে আশা সখীর উপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইয়াছিল।

 স্বামীকে বলিল, “রোসো, দু-চারি দিন আগে আলাপ হউক, তার পরে তো বলিবে। কাল কতক্ষণেরই বা দেখা, কটা কথাই বা হইয়াছিল।”

 ইহাতেও মহেন্দ্র কিছু নিরাশ হইল এবং বিনোদিনী সম্বন্ধে নিশ্চেষ্টত দেখানো তাহার পক্ষে আরো দুরূহ হইল।

 এই-সকল আলোচনার মধ্যে বিহারী আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কী মহিনদা, আজ তোমাদের তর্কটা কী লইয়া।”

 মহেন্দ্র কহিল, “দেখো তো ভাই, কুমুদিনী না প্রমোদিনী না কার সঙ্গে তোমার বোঠান চুলের দড়ি না মাছের কাটা না কী-একটা পাতাইয়াছেন, কিন্তু আমাকে তাই বলিয়া তাঁর সঙ্গে চুরোটের ছাই কিংবা দেশালাইয়ের কাঠি পাতাইতে হইবে, এ হইলে তো বাঁচা যায় না।”

 আশার ঘোমটার মধ্যে নীরবে তুমুল কলহ ঘনাইয়া উঠিল। বিহারী ক্ষণকাল নিরুত্তরে মহেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া হাসিল; কহিল, “বোঠান, লক্ষণ ভালো নয়। এ-সব ভোলাইবার কথা। তোমার চোখের বালিকে আমি দেখিয়াছি। আরো যদি ঘন ঘন দেখিতে পাই, তবে সেটাকে দুর্ঘটনা বলিয়া মনে করিব না, সে আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি। কিন্তু মহিনদা যখন এত করিয়া বেকবুল যাইতেছেন তখন বড়ো সন্দেহের কথা।”

 মহেন্দ্রের সঙ্গে বিহারীর যে অনেক প্রভেদ, আশা তাহার আর-একটি প্রমাণ পাইল।

 হঠাৎ মহেন্দ্রের ফোটোগ্রাফ-অভ্যাসের শখ চাপিল। পূর্বে সে একবার ফোটোগ্রাফি শিখিতে আরম্ভ করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছিল। এখন আবার ক্যামের মেরামত করিয়া, আরক কিনিয়া, ছবি তুলিতে শুরু করিল। বাড়ির চাকর-বেহারাদের পর্যন্ত ছবি তুলিতে লাগিল।

 আশা ধরিয়া পড়িল চোখের বালির একটা ছবি লইতেই হইবে।

 মহেন্দ্র অত্যন্ত সংক্ষেপে বলিল, “আচ্ছা।”

 চোখের বালি তদপেক্ষা সংক্ষেপে বলিল, “না।”