পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

হইতে লাগিল। সে এপাশ ওপাশ করিয়া ঘুমাইবার অনেক চেষ্টা করিল— পাশেই ললিতাকে গভীর সুপ্তিতে মগ্ন দেখিয়া তাহার ঈর্ষা জন্মিল, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসিল না। বিরক্ত হইয়া সে বিছানা ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিল। খোলা দরজার কাছে দাঁড়াইয়া সম্মুখের ছাতের দিকে চাহিয়া রহিল— মাঝে মাঝে বাতাসের বেগে গায়ে বৃষ্টির ছাট লাগিতে লাগিল। ঘুরিয়া ফিরিয়া আজ সন্ধ্যাবেলাকার সমস্ত ব্যাপার তন্ন তন্ন করিয়া তাহার মনে উদয় হইল। সেই সূর্যাস্তরঞ্জিত গাড়িবারান্দার উপর গোরার উদ্দীপ্ত মুখ স্পষ্ট ছবির মতো তাহার স্মৃতিতে জাগিয়া উঠিল এবং তখন তর্কের যে-সমস্ত কথা কানে শুনিয়া ভুলিয়া গিয়াছিল সে-সমস্তই গোরার গভীর প্রবল কণ্ঠস্বরে জড়িত হইয়া আগাগোড়া তাহার মনে পড়িল। কানে বাজিতে লাগিল, ‘আপনারা যাদের অশিক্ষিত বলেন, আমি তাদেরই দলে— আপনারা যাকে কুসংস্কার বলেন আমার সংস্কার তাই। যতক্ষণ না আপনি দেশকে ভালো- বাসবেন এবং দেশের লোকের সঙ্গে এক জায়গায় এসে দাঁড়াতে পারবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার মুখ থেকে দেশের নিন্দা আমি এক বর্ণও সহ্য করতে পারব না।’ এ কথার উত্তরে পানুবাবু কহিলেন, ‘এমন করলে দেশের সংশোধন হবে কী করে?’ গোরা গর্জিয়া উঠিয়া কহিল, ‘সংশোধন। সংশোধন ঢের পরের কথা। সংশোধনের চেয়েও বড়ো কথা ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। আগে আমরা এক হব, তা হলেই সংশোধন ভিতর থেকে আপনিই হবে। আপনারা যে পৃথক হয়ে দেশকে খণ্ড খণ্ড করতে চান— আপনারা বলেন, দেশের কুসংস্কার আছে, অতএব আমরা সুসংস্কারীর দল আলাদা হয়ে থাকব। আমি এই কথা বলি, আমি কারও চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে কারও থেকে পৃথক হব না, এই আমার সকলের চেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা— তার পর এক হ'লে কোন্ সংস্কার থাকবে, কোন্ সংস্কার যাবে, তা আমার দেশই জানে এবং দেশের যিনি বিধাতা তিনিই জানেন।’ পানুবাবু কহিলেন, ‘এমন-সকল প্রথা ও সংস্কার আছে যা দেশকে এক হতে দিচ্ছে না।’ গোরা কহিল, ‘যদি এই কথা মনে করেন যে, আগে সেই-সমস্ত-প্রথা ও সংস্কারকে একে একে

৭৯