পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০
চোখের বালি

 অন্নপূর্ণাকে থাকিতে হইল, কিন্তু তিনি লজ্জায় ক্ষোভে ও বিরক্তিতে সংকুচিত হইয়া রহিলেন। খুড়ির এইরূপ দূরভাব দেখিয়া মহেন্দ্র রাগ করিল এবং আশাও অভিমান করিয়া রহিল।


রাজলক্ষ্মী জন্মভূমিতে পৌঁছিলেন। বিহারী তাঁহাকে পৌঁছাইয়া চলিয়া আসিবে এরূপ কথা ছিল, কিন্তু সেখানকার অবস্থা দেখিয়া সে ফিরিল না।

 রাজলক্ষ্মীর পৈতৃক বাটীতে দুই-একটি অতিবৃদ্ধ বিধবা বাঁচিয়া ছিলেন মাত্র। চারি দিকে ঘন জঙ্গল ও বাঁশবন, পুষ্করিণীর জল সবুজবর্ণ, দিনে দুপুরে শেয়ালের ডাকে রাজলক্ষ্মীর চিত্ত উদ্ভ্রান্ত হইয়া উঠে।

 বিহারী কহিল, “মা, জন্মভূমি বটে, কিন্তু ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ কোনোমতেই বলিতে পারি না। কলিকাতায় চলো। এখানে তোমাকে পরিত্যাগ করিয়া গেলে আমার অধর্ম হইবে।”

 রাজলক্ষ্মীরও প্রাণ হাঁপাইয়া উঠিয়াছিল, এমন সময়ে বিনোদিনী আসিয়া তাঁহাকে আশ্রয় দিল এবং আশ্রিয় করিল।

 বিনোদিনীর পরিচয় প্রথমেই দেওয়া হইয়াছে। এক সময়ে মহেন্দ্র এবং তদ্ভাবে বিহারীর সহিত তাহার বিবাহের প্রস্তাব হইয়াছিল। বিধিনির্বন্ধে যাহার সহিত তাহার শুভ বিবাহ হয়, সে লোকটির সমস্ত অন্তরিন্দ্রিয়ের মধ্যে প্লীহাই ছিল সর্বাপেক্ষা প্রবল। প্লীহার অতিভারেই সে দীর্ঘকাল জীবনধারণ করিতে পারিল না।

 তাহার মৃত্যুর পর হইতে বিনোদিনী, জঙ্গলের মধ্যে একটিমাত্র উদ্যানলতার মতে, নিরানন্দ পল্লীর মধ্যে মুহ্যমান ভাবে জীবনযাপন করিতেছিল। অদ্য সেই অনাথা আসিয়া তাহার রাজলক্ষ্মৗ-পিস্‌শাশ-ঠাকরুনকে ভক্তিভরে প্রণাম করিল এবং তাঁহার সেবায় আত্মসমর্পণ করিয়া দিল।

 সেবা ইহাকেই বলে! মুহূর্তের জন্য আলস্য নাই। কেমন পরিপাটি কাজ, কেমন সুন্দর রান্না, কেমন মুমিষ্ট কথাবার্তা।

 রাজলক্ষ্মী বলেন, “বেলা হইল মা, তুমি দুটি খাও গে যাও।”

 সে কি শোনে। পাখা করিয়া পিসিমাকে ঘুম না পাড়াইয়া সে উঠে না।

 রাজলক্ষ্মী বলেন, “এমন করিলে যে তোমার অসুখ করিবে, মা।”

 বিনোদিনী নিজের প্রতি নিরতিশয় তাচ্ছিল্য প্রকাশ করিয়া বলে, “আমাদের দুঃখের শরীরে অসুখ করে না পিসিমা। আহা, কতদিন পরে জন্মভূমিতে