পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫৪
চোখের বালি

তপসিমাছওয়ালা তপসিমাছ হাঁকিতেছিল। কলরবক্ষুব্ধ জনতার মধ্যে মহেন্দ্র প্রবেশ করিল এবং অদৃশ্য হইয়া গেল।


৩৭

বিহারী একলা নিজেকে লইয়া অন্ধকার রাত্রে কখনো ধ্যান করিতে বসে না। কোনো কালেই বিহারী নিজের কাছে নিজেকে আলোচ্য বিষয় করে নাই। সে পড়াশুনা কাজকর্ম বন্ধুবান্ধব লোকজন লইয়া থাকিত। চারি দিকের সংসারকেই সে নিজের চেয়ে প্রাধান্য দিয়া আনন্দে ছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন প্রবল আঘাতে তাহার চারি দিক যেন বিশ্লিষ্ট হইয়া পড়িয়া গেল; প্রলয়ের অন্ধকারে অভ্রভেদী বেদনার গিরিশৃঙ্গে নিজেকে একলা লইয়া দাঁড়াইতে হইল। সেই হইতে নিজের নির্জন সঙ্গকে সে ভয় করিতে আরম্ভ করিয়াছে; জোর করিয়া নিজের ঘাড়ে কাজ চাপাইয়া এই সঙ্গীটিকে সে কোনোমইে অবকাশ দিতে চায় না।

 কিন্তু আজ নিজের সেই অন্তরবাসীকে বিহারী কোনোমতেই ঠেলিয়া রাখিতে পারিল না। কাল বিনোদিনীকে বিহারী দেশে পৌঁছাইয়া দিয়া আসিয়াছে, তাহার পর হইতে সে যে-কোনো কাজে যে-কোনো লোকের সঙ্গেই আছে, তাহার গুহাশায়ী বেদনাতুর হৃদয় তাহাকে নিজের নিগূঢ় নির্জনতার দিকে অবিশ্রাম আকর্ষণ করিতেছে।

 শ্রান্তি ও অবসাদে আজ বিহারীকে পরাস্ত করিল। রাত্রি তখন নয়টা হইবে; বিহারীর গৃহের সম্মুখবর্তী দক্ষিণের ছাদের উপর দিনান্তরম্য গ্রীষ্মের বাতাস উতলা হইয়া উঠিয়াছে। বিহারী চন্দ্রোদয়হীন অন্ধকারে ছাদে একখানি কেদারা লইয়া বসিয়া আছে।

 বালক বসন্তকে আজ সন্ধ্যাবেলায় সে পড়ায় নাই― সকাল-সকাল তাহাকে বিদায় করিয়া দিয়াছে। আজ সান্ত্বনার জন্য, সঙ্গের জন্য, তাহার চিরাভ্যন্ত প্রীতিসুধাস্নিগ্ধ পূর্বজীবনের জন্য, তাহার হৃদয় যেন মাতৃ-পরিত্যক্ত শিশুর মতো বিশ্বের অন্ধকারের মধ্যে দুই বাহু তুলিয়া কাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। আজ তাহার দৃঢ়তা, তাহার কঠোর সংযমের বাঁধ কোথায় ভাঙিয়া গেছে। যাহাদের কথা ভাবিবে না পণ করিয়াছিল, সমস্ত হৃদয় তাহাদের দিকে ছুটিয়াছে; আজ আর পথরোধ করিবার লেশমাত্র বল নাই।

 মহেন্দ্রের সহিত বাল্যকালের প্রণয় হইতে সেই প্রণয়ের অবসান পর্যন্ত সমস্ত