পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৬৩

গিয়াছে— তখন বিনোদিনী হঠাৎ দ্বারে আঘাত শুনিয়া ভূমিতল হইতে দ্রুতবেগে দাঁড়াইয়া উঠিল, অসংশয় বিশ্বাসে ছুটিয়া দ্বার খুলিয়া কহিল, “প্রভু, আসিয়াছ?”

 তাহার দৃঢ় প্রত্যয় হইল, এই মুহূর্তে জগতের আর-কেহই তাহার দ্বারে আসিতে পারে না।

 মহেন্দ্র কহিল, “আসিয়াছি বিনোদ।”

 বিনোদিনী অপরিসীম বিরাগ ও প্রচণ্ড ধিক্‌কারের সহিত বলিয়া উঠিল, “যাও, যাও, যাও এখান হইতে। এখনই যাও।”

 মহেন্দ্র অকস্মাৎ স্তম্ভিত হইয়া গেল।

 “হ্যাঁলা বিন্দি, তোর দিদিশাশুড়ি যদি কাল”— এই কথা বলিতে বলিতে কোনো প্রৌঢ়া প্রতিবেশিনী বিনোদিনীর দ্বারের কাছে আসিয়া “ওমা” বলিয়া মস্ত ঘোমটা টানিয়া সবেগে পলায়ন করিল।


৩৯

পাড়ায় ভারি একটা গোলমাল পড়িয়া গেল। পল্লীবৃদ্ধেরা চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া কহিল, ‘এ কখনোই সহ্য করা যাইতে পারে না। কলিকাতায় কী ঘটিতেছিল তাহা কানে না তুলিলেও চলিত, কিন্তু এমন সাহস যে মহেন্দ্রকে চিঠির উপর চিঠি লিখিয়া পাড়ায় আনিয়া এমন প্রকাশ্য নির্লজ্জতা! এরূপ ভ্রষ্টাকে গ্রামে রাখিলে তো চলিবে না।’

 বিনোদিনী আজ নিশ্চয় আশা করিয়াছিল, বিহারীর পত্রের উত্তর পাইবে, কিন্তু উত্তর আসিল না! বিনোদিনী মনে মনে বলিতে লাগিল, ‘আমার উপরে বিহারীর কিসের অধিকার। আমি কেন তাহার হুকুম শুনিতে গেলাম। আমি কেন তাহাকে বুঝিতে দিলাম যে, সে আমার প্রতি যেমন বিধান করিবে আমি তাহাই নতশিরে গ্রহণ করিব। তাহার ভালোবাসার আশাকে বাঁচাইবার জন্য যেটুকু দরকার আমার সঙ্গে কেবলমাত্র তাহার সেইটুকু সম্পর্ক? আমার, নিজের কোনো প্রাপ্য নাই, দাবি নাই, সামান্য দুই ছত্র চিঠিও না— আমি এত তুচ্ছ, এত ঘৃণার সামগ্রী!’ তখন ঈর্ষার বিষে বিনোদিনীর সমস্ত বক্ষ পূর্ণ হইয়া উঠিল সে কহিল, ‘আর-কাহারো জন্য এত দুঃখ সহ্য় করা যাইতে পারে, কিন্তু তাই বলিয়া আশার জন্য নয়। এই দৈন্য, এই বনবাস, এই লোকনিন্দা, এই অবজ্ঞা, এই জীবনের সকল প্রকার অপরিতৃপ্তি, কেবল আশারই জন্য আমাকে বহন করিতে হইবে— এতবড়ো ফাঁকি আমি মাথায় করিয়া কেন লইলাম। কেন আমার