পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
২২৯

 আশা কহিল, “তুমি একবার নিজে দেখিবে এসো― আমার তো বোধ হয়, ব্যামো আরো বাড়িয়াছে।”

 তখন বিহারী ঘরে প্রবেশ করিল। মহেন্দ্র বাহিরে দাঁড়াইয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। আশা বাড়ির কর্তৃত্ব অনায়াসে গ্রহণ করিয়াছে— সে মহেন্দ্রকে কেমন সহজে ঘরে ঢুকিতে নিষেধ করিল। না করিল সংকোচ, না করিল অভিমান। মহেন্দ্রের বল আজ কতখানি কমিয়া গেছে। সে অপরাধী, সে বাহিরে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল― মার ঘরেও ঢুকিতে পারিল না।

 তাহার পরে ইহাও আশ্চর্য― বিহারীর সঙ্গে আশা কেমন অকুণ্ঠিত ভাবে কথাবার্তা কহিল। সমস্ত পরামর্শ তাহারই সঙ্গে। সেই আজ সংসারের একমাত্র রক্ষক, সকলের সুহৃৎ। তাহার গতিবিধি সর্বত্র, তাহার উপদেশেই সমস্ত চলিতেছে। মহেন্দ্র কিছুদিনের জন্য যে জায়গাটি ছাড়িয়া চলিয়া গেছে, ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, সে জায়গা ঠিক আর তেমনটি নাই।

 বিহারী ঘরে ঢুকিতেই রাজলক্ষ্মী তাঁহার করুণ চক্ষু তাহার মুখের দিকে রাখিয়া কহিলেন, “বিহারী, ফিরিয়াছিস?”

 বিহারী কহিল, “হাঁ মা, ফিরিয়া আসিলাম।”

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তোর কাজ শেষ হইয়া গেছে?”

 বলিয়া তাহার মুখের দিকে একাগ্রদৃষ্টিতে চাহিলেন।

 বিহারী প্রফুল্লমুখে “হাঁ মা, কাজ সুসম্পন্ন হইয়াছে, এখন আমার আর-কোনো ভাবনা নাই” বলিয়া একবার বাহিরের দিকে চাহিল।

 রাজলক্ষ্মী। আজ বউমা তোমার জন্য নিজের হাতে রাঁধিবেন, আমি এখান হইতে দেখাইয়া দিব। ডাক্তার বারণ করে কিন্তু আর বারণ কিসের জন্য বাছা। আমি কি একবার তোদের খাওয়া দেখিয়া যাইব না।

 বিহারী কহিল, “ডাক্তারের বারণ করিবার তো কোনো হেতু দেখি না মা― তুমি না দেখাইয়া দিলে চলিবে কেন। ছেলেবেলা হইতে তোমার হাতের রান্নাই আমরা ভালোবাসিতে শিখিয়াছি― মহিনদার তো পশ্চিমের ডালরুটি খাইয়া অরুচি ধরিয়া গেছে― আজ সে তোমার মাছের ঝোল পাইলে বাঁচিয়া যাইবে। আজ আমরা দুই ভাই ছেলেবেলাকার মতো রেষারেষি করিয়া খাইব, তোমার বউমা অন্নে কুলাইতে পারিলে হয়।”

 যদিচ রাজলক্ষ্মী বুঝিয়াছিলেন, বিহারী মহেন্দ্রকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে, তবু তাহার নাম শুনিতেই তাঁহার হৃদয় স্পন্দিত হইয়া নিশ্বাস ক্ষণকালের জন্য