পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

আমার মুখ দিয়ে বের হতে পারত না। কিন্তু এখন আমার মন খুব জোরের সঙ্গে অসংকোচে বলছে ‘আমি হিন্দু’। এতে আমি খুব একটা আনন্দ বোধ করছি।”

 পরেশবাবু কহিলেন, “এ কথাটার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অংশ-প্রত্যংশ সমস্তই কি ভেবে দেখেছ?”

 সুচরিতা কহিল, “সমস্ত ভেবে দেখবার শক্তি কি আমার নিজের আছে? কিন্তু এই কথা নিয়ে আমি অনেক পড়েছি, অনেক আলোচনাও করেছি। এই জিনিসটাকে যখন আমি এমন বড়ো করে দেখতে শিখি নি তখনই হিন্দু বলতে যা বোঝায় কেবল তার সমস্ত ছোটোখাটো খুঁটিনাটিকেই বড়ো করে দেখেছি- তাতে সমস্তটার প্রতি আমার মনের মধ্যে ভারী একটা ঘৃণা বোধ হত।”

 পরেশবাবু তাহার কথা শুনিয়া বিস্ময় অনুভব করিলেন; তিনি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন, সুচরিতার মনের মধ্যে একটা বোধসঞ্চার হইয়াছে, সে একটা-কিছু সত্যবস্তু লাভ করিয়াছে বলিয়া নিঃসংশয়ে অনুভব করিতেছে-সে যে মুগ্ধের মতো কিছুই না বুঝিয়া কেবল একটা অস্পষ্ট আবেগে ভাসিয়া যাইতেছে তাহা নহে।

 সুচরিতা কহিল, “বাবা, আমি যে আমার দেশ থেকে, জাত থেকে বিচ্ছিন্ন একজন ক্ষুদ্র মানুষ এমন কথা আমি কেন বলব? আমি কেন বলতে পারব না ‘আমি হিন্দু’?”

 পরেশ হাসিয়া কহিলেন, “অর্থাৎ, মা, তুমি আমাকেই জিজ্ঞাসা করছ, আমি কেন নিজেকে হিন্দু বলি নে। ভেবে দেখতে গেলে তার যে খুব গুরুতর কোনো কারণ আছে তা নয়। একটা কারণ হচ্ছে হিন্দুরা আমাকে হিন্দু ব’লে স্বীকার করে না; আর-একটা কারণ যাদের সঙ্গে আমার ধর্মমতে মেলে তারা নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দেয় না।”

 সুচরিতা চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিল। পরেশ কহিলেন, “আমি তো তোমাকে বলেইছি, এগুলি গুরুতর কারণ নয়, এগুলি বাহ্য কারণ মাত্র। এ

৫২২