পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 পরেশবাবু যখন ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন তখন ললিতা একটা চৌকি অধিকার করিয়া দৃঢ় হইয়া বসিল এবং হারানবুবর মুখের দিকে দৃষ্টি স্থির করিয়া কহিল, “আপনি মনে করেন সকলকেই আপনার সব কথা বলবার অধিকার আছে!"

 ললিতাকে সুচরিতা চিনিত। অন্যদিন হইলে ললিতার এরূপ মূর্তি দেখিলে সে মনে মনে উদ্‌বিগ্ন হইয়া উঠিত। আজ সে জানলার ধারের চৌকিতে বসিয়া একটা বই খুলিয়া চুপ করিয়া তাহার পাতার দিকে চাহিয়া রহিল। নিজেকে সংবরণ করিয়া রাখাই সুচরিতার চিরদিনের স্বভাব ও অভ্যাস। এই কয়দিন ধরিয়া নানাপ্রকার আঘাতের বেদনা তাহার মনে যতই বেশি করিয়া সঞ্চিত হইতেছিল ততই সে আরো বেশি করিয়া নীরব হইয়া উঠিতেছিল। আজ তাহার এই নীরবতার ভার দুর্বিষহ হইয়াছে— এইজন্য ললিতা যখন হারানের নিকট তাহার মন্তব্য প্রকাশ করিতে বসিল তখন সুচরিতার রুদ্ধ হৃদয়ের বেগ যেন মুক্তিলাভ করিবার অবসর পাইল।

 ললিতা কহিল, “আমাদের সম্বন্ধে বাবার কী কর্তব্য, আপনি মনে করেন, বাবার চেয়ে আপনি তা ভালো বোঝেন! সমস্ত ব্রাহ্মসমাজের আপনিই হচ্ছেন হেড্‌মাস্টার!"

 ললিতার এইপ্রকার ঔদ্ধত্য দেখিয়া হারানবাবু প্রথমটা হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিলেন। এইবার তিনি তাহাকে খুব একটা কড়া জবাব দিতে যাইতেছিলেন— ললিতা তাহতে বাধা দিয়া তাঁহাকে কহিল, “এতদিন আপনার শ্রেষ্ঠতা আমরা অনেক সহ্য করেছি, কিন্তু আপনি যদি বাবার চেয়েও বড়ো হতে চান তা হলে এ বাড়িতে আপনাকে কেউ সহ্য করতে পারবে না— আমাদের বেয়ারাটা পর্যন্ত না।”

 হারানবাবু বলিয়া উঠিলেন, “ললিতা, তুমি—"

 ললিতা তাঁহাকে বাধা দিয়া তীব্রস্বরে কহিল, “চুপ করুন। আপনার কথা আমরা অনেক শুনেছি, আজ আমার কথাটা শুনুন। যদি বিশ্বাস না করেন তবে সুচিদিদিকে জিজ্ঞাসা করবেন— আপনি নিজেকে যত বড়ো

২৬৮