পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি হিন্দুসমাজেই থাকতে চাও?”

 বিনয় কহিল, “হাঁ”

 পরেশবাবু ললিতার মুখের দিকে চাহিলেন। ললিতা তাঁহার মনের ভাব বুঝিয়া কহিল, “বাবা, আমার যা ধর্ম তা আমার আছে এবং বরাবর থাকবে। আমার অসুবিধা হতে পারে, কষ্টও হতে পারে; কিন্তু যাদের সঙ্গে আমার মতের এমন-কি আচরণের অমিল আছে তাদের পর করে দিয়ে তফাতে না সরিয়ে রাখলে আমার ধর্মে বাধবে, এ কথা আমি কোনোমতেই মনে করতে পারি নে।”

 পরেশবাবু চুপ করিয়া রহিলেন। ললিতা কহিল, “আগে আমার মনে হত ব্রাহ্মসমাজই যেন একমাত্র জগৎ, এর বাইরে যেন সব ছায়া। ব্রাহ্মসমাজ থেকে বিচ্ছেদ যেন সমস্ত সত্য থেকে বিচ্ছেদ। কিন্তু এই কয়দিনে সে ভাব আমার একেবারে চলে গেছে।”

 পরেশবাবু স্নানভাবে একটু হাসিলেন।

 ললিতা কহিল, “বাবা, আমি তোমাকে জানাতে পারি নে আমার কতবড়ো একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে আমি যে-সব লোক দেখছি তাদের অনেকের সঙ্গে আমার ধর্মমত এক হলেও তাদের সঙ্গে তো আমি কোনোমতেই এক নই- তবু ব্রাহ্মসমাজ ব’লে একটা নামের আশ্রয় নিয়ে তাদেরই আমি বিশেষ করে আপন বলব, আর পৃথিবীর অন্য সব লোককেই দূরে রেখে দেব, আজকাল আমি এর কোনো মানে বুঝতে পারি নে।”

 পরেশবাবু তাঁহার বিদ্রোহী কন্যার পিঠে ধীরে ধীরে হাত বুলাইয়া কহিলেন, “ব্যক্তিগত কারণে মন যখন উত্তেজিত থাকে তখন কি বিচার ঠিক হয় পূর্বপুরুষ থেকে সন্তানসন্ততি পর্যন্ত মানুষের যে একটা পূর্বাপরতা আছে তার মঙ্গল দেখতে গেলে সমাজের প্রয়োজন হয়—সে প্রয়োজন তো কৃত্রিম প্রয়োজন নয়। তোমাদের ভাবী বংশের মধ্যে যে দুরব্যাপী ভবিষ্যৎ রয়েছে তার ভার যার উপরে স্থাপিত সেই তোমাদের সমাজ, তার কথা কি

৪৫৯