পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

ঘরে চলে, হিন্দুর ঘরে না। আমি তাঁকে আমাদের কৈলাসের কথাও খুলে বলেছি। দেখলুম লোকটি জ্ঞানী বটে।”

 লজ্জায় কষ্টে সুচরিতা মর্মে মরিতে লাগিল। হরিমোহিনী কহিলেন, “তুমি তো তাঁকে গুরু বলে মানো। তাঁর কথাটা তো পালন করতে হবে?”

 সুচরিতা চুপ করিয়া রহিল। হরিমোহিনী কহিলেন, “আমি তাঁকে বললুম, ‘বাবা, তুমি নিজে এসে তাকে বুঝিয়ে যাও, সে আমাদের কথা মানে না।’ তিনি বললেন, ‘না, তার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া উচিত হবে না; ওটা আমাদের হিন্দুসমাজে বাধে।’ আমি বললুম, ‘তবে উপায় কী?’ তখন তিনি আমাকে নিজের হাতে লিখে দিলেন। এই দেখো-না।”

 এই বলিয়া হরিমোহিনী ধীরে ধীরে আঁচল হইতে কাগজটি খুলিয়া লইয়া তাহার ভাঁজ খুলিয়া সুচরিতার সম্মুখে মেলিয়া দিলেন।

 সুচরিতা পড়িল। তাহার যেন নিঃশ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিল। সে কাঠের পুতুলের মতো আড়ষ্ট হইয়া বসিয়া রহিল।

 লেখাটির মধ্যে এমন কিছুই ছিল না যাহা নূতন বা অসংগত। কথাগুলির সহিত সুচরিতার মতের যে অনৈক্য আছে তাহাও নহে। কিন্তু হরিমোহিনীর হাত দিয়া বিশেষ করিয়া এই লিখনটি তাহাকে পাঠাইয়া দেওয়ার যে অর্থ তাহাই সুচরিতাকে নানা প্রকারে কষ্ট দিল। গোরার কাছ হইতে এ আদেশ আজ কেন! অবশ্য, সুচরিতারও সময় উপস্থিত হইবে, তাহাকেও একদিন বিবাহ করিতে হইবে- সেজন্য গোরার পক্ষে এত ত্বরান্বিত হইবার কি কারণ ঘটিয়াছে? তাহার সম্বন্ধে গোরার কাজ একেবারে শেষ হইয়া গেছে? সে কি গোরার কর্তব্যে কোনো হানি করিয়াছে? তাহার জীবনের পথে কোনো বাধা ঘটাইয়াছে? তাহাকে গোরার দান করিবার এবং তাহার নিকট প্রত্যাশা করিবার আর-কিছুই নাই? সে কিন্তু এমন করিয়া ভাবে নাই, সে কিন্তু এখনো পথ চাহিয়া ছিল। সুচরিতা নিজের ভিতরকার এই অসহ্য কষ্টের বিরুদ্ধে লড়াই করিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিল, কিন্তু সে মনের মধ্যে কোথাও কিছুমাত্র সান্ত্বনা পাইল না।

৫৭৮