পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 সুচরিতা কহিল, “কিছুমাত্র না। যে কথাটা নিয়ে খুব বেশি আন্দোলন হচ্ছে ললিতাই তার জন্যে দায়ী। ললিতা যে হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে স্টীমারে চলে যাবে বিনয়বাবু তা কখনো কল্পনাও করেন নি। লোকে এমনভাবে কথা কচ্ছে যেন ওদের দুজনের মধ্যে গোপনে পরামর্শ হয়ে গিয়েছিল। আবার ললিতা এমনি তেজস্বিনী মেয়ে, সে যে প্রতিবাদ করবে কিংবা কোনোরকমে বুঝিয়ে বলবে আসল ঘটনাটা কী ঘটেছিল, সে তার দ্বারা কোনোমতেই হবার জো নেই।”

 আনন্দময়ী কহিলেন, “এর তো একটা উপায় করতে হচ্ছে। এই-সব কথা শুনে অবধি বিনয়ের মনে তো কিছুমাত্র শান্তি নেই— সে তো নিজেকেই অপরাধী বলে ঠাউরে বসে আছে।”

 সুচরিতা তাহার আরক্তিম মুখ একটুখানি নিচু করিয়া কহিল, “আচ্ছা, আপনি কি মনে করেন বিনয়বাবু।”

 আনন্দময়ী সংকোচপীড়িতা সুচরিতাকে তাহার কথা শেষ করিতে না দিয়া কহিলেন, “দেখো বাছা, আমি তোমাকে বলছি ললিতার জন্যে বিনয়কে যা করতে বলবে সে তাই করবে। বিনয়কে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি। ও যদি একবার আত্মসমর্পণ করল, তবে ও আর কিছু হাতে রাখতে পারে না। সেইজন্যে আমাকে বড়ো ভয়ে ভয়েই থাকতে হয়, ওর পাছে এমন জায়গায় মন যায় যেখানে থেকে ওর কিছুই ফিরে পাবার কোনো আশা নেই।”

 সুচরিতার মন হইতে একটা বোঝা নামিয়া গেল। সে কহিল, “ললিতার সম্মতির জন্যে আপনাকে কিছুই ভাবতে হবে না, আমি তার মন জানি। কিন্তু বিনয়বাবু কি তাঁর সমাজ পরিত্যাগ করতে রাজি হবেন?”

 আনন্দময়ী কহিলেন, “সমাজ হয়তো তাকে পরিত্যাগ করতে পারে, কিন্তু সে আগেভাগে গায়ে পড়ে সমাজ পরিত্যাগ করতে যাবে কেন মা? তার কি কোনো প্রয়োজন আছে?”

 সুচরিতা কহিল, “বলেন কী মা? বিনয়বাবু হিন্দুসমাজে থেকে ব্রাহ্ম-

৩৮৭